২০ লাখ টাকা দিয়েও স্বামীকে ফিরে পাননি সালমা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও যুবদল নেতা সামছুল ইসলাম সোলায়মানকে অপহরণ করা হয়েছিল রাজধানীর উত্তরা থেকে। তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় লক্ষ্মীপুরে। অস্ত্র ঠেকিয়ে অপহরণের পর একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণের দু’দিন পর পাওয়া যায় তার লাশ। এই দু’দিনে স্বামীর জন্য হন্যে হয়ে ছুটেছেন নিহতের স্ত্রী সালমা ইসলাম মায়া। অপহরণকারীরা যোগাযোগও করেছিল তার সঙ্গে। ক্ষণে ক্ষণে জানিয়েছে সোলায়মানের অবস্থান। একটি বিশেষ সংস্থার দু’টি অঞ্চলের কার্যালয়ে তাকে রাখার কথাও জানায় তারা। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আছেন এমনটি ভেবে সালমা স্বামীকে জীবিত ফেরত পাওয়ার আশায় ছিলেন। এজন্য অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দিতেও রাজি হন তিনি। সোলায়মানকে জীবিত ফেরত দেয়ার শর্তে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। পুরো টাকা না পেয়ে ধার দেনা করে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন সালমা। অপহরণকারীদের কথা মতো কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় এক যুবকের হাতে এ টাকা তুলে দেন তিনি। তবে টাকা দিয়েও কাজ হয়নি। পরের দিনই পাওয়া যায় সোলায়মানের লাশ। এ ঘটনার এক মাসের বেশি সময় পার হলেও এ পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পায়নি সোলায়মানের পরিবার। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় একটি বিশেষ বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আসার পর সোলায়মানের ব্যবসায়ী ভাইকে অস্ত্রধারী যুবকরা হুমকি দেয়ায় নতুন করে আতঙ্ক ভর করেছে ওই পরিবারে। অস্ত্রধারী যুবকরা হুমকি দিয়ে বলেছে, আওয়ামী লীগ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দিলে তাকেও সোলায়মানের পরিণতি ভোগ করতে হবে। এদিকে নিহত সোলায়মানের পরিবারের অন্য সদস্যরা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সোলায়মানের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে নিরাপত্তাহীনতার কারণে। বাসার প্রধান ফটকে তালা দিয়ে অনেকটা অন্তরীণ অবস্থায় থাকছেন তারা।
সোলায়মানের পরিবারের দাবি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক’জন নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরে সোলায়মানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কলকাঠি নেড়েছেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্য। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে সোলায়মানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও সোলায়মান অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠা লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার। সোলায়মানের পরিবারের অভিযোগ বিষয়টি অবগত হয়ে ঘটনার কয়েক দিন আগেই বিদেশে পাড়ি জমান ওই সংসদ সদস্য আর অপহরণকারীদের সহযোগিতা করেছে একটি বিশেষ বাহিনী। সোলায়মানের স্ত্রীর দাবি সোলায়মান অপহরণের পর পরই ঢাকা থেকে তাকে লক্ষ্মীপুর নেয়া পর্যন্ত অপহরণকারীদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। অপহরণকারীরাই তাকে জানিয়েছেন ওই বাহিনীর ঢাকার একটি সদর দপ্তর থেকে কুমিল্লা অঞ্চলের ক্যাম্পে নেয়া হয়। সেখান থেকে নেয়া হয় লক্ষ্মীপুরে। এ ঘটনায় বিশেষ বাহিনীর কারা জড়িত এমনটি তারা আঁচ করতে পারলেও নিরাপত্তার কারণে তারা তা বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে গণমাধ্যম বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ দিতে পারছেন না নিরাপত্তার কারণে।
গত ২৪শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকার গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সামছুল ইসলাম সোলায়মানকে রাজধানীর উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের জয়নাল মার্কেটের সামনে থেকে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। ২৬শে এপ্রিল সোলায়মানের নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুর জেলার বসুরহাট এলাকার স্লুইস গেটের পাশে তার গুলিবিদ্ধ ও শরীরের বিভিন্নস্থানে অসংখ্য আঘাতের চিন্থ সম্বলিত লাশ পাওয়া যায়।
গত মঙ্গলবার সোলায়মানের ভাই রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দু’জন যুবক তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দিয়েছে। তারা বলেছে যা হওয়ার হয়েছে। এ বিষয়ে যেন আর বাড়াবাড়ি না করা হয়। পিস্তল হাতে হুমকিদাতারা নিষেধ করেছে সোলায়মান অপহরণ ও হত্যার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কাউকে জড়িয়ে এ বিষয়ে মুখ না খোলার জন্য। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সোলায়মানের পরিণতি হবে বলে হুমকি দেয় তারা। এ ঘটনার পর থেকেই সোলায়মানের ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ভয়ে তারা মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। সোলায়মানের স্ত্রী সালমা ইসলাম মায়া মানবজমিনকে জানান, ঘটনার পর থেকেই অব্যাহত হুমকি ও নিরপত্তার কারণে একপ্রকার গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। এমনকি লক্ষ্মীপুরে সোলায়মানের লাশ পাওয়ার পর ওইদিন কোনমতে স্বামীর কবরে মাটি দিয়ে দুই পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। একদিকে ২০ লাখ টাকা দিয়েও স্বামীকে ফেরত পাননি তিনি। পুত্র-কন্যারা পায়নি তাদের পিতাকে। অন্যদিকে হত্যাকারীদের লাগাতার হুমকিতে তাদের জীবন কাটছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়।
বুধবার রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর এলাকার একটি ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে কথা হয় সালমা ইসলাম মায়ার সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সোলায়মান অপহৃত হওয়ার পর অপহরণকারীরা ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। আত্মীয়স্বজন ও ধার-দেনা করে ২০ লাখ টাকা জোগাড় করি। অপহরণকারীদের কথামতো পরদিনই একটি শপিং ব্যাগে করে কুড়িল বিশ্বরোডে ফ্লাইওভারের নিচে টাকা নিয়ে গিয়েছি। সাদা শার্ট ও প্যান্ট পরা ২৫-২৬ বছরের এক যুবকের হাতে টাকার ব্যাগ তুলে দিয়েছি অপহরণকারীদের কথামতো। কিন্তু টাকা দিয়েও কোন লাভ হয়নি। ২০ লাখ টাকা দিয়ে পেলাম স্বামীর লাশ। তিনি বলেন যে গাড়িতে করে সোলায়মানকে অপহরণ করা হয়েছে তা ছিল ক্রিম কালারের একটি বড় মাইক্রোবাস। এসব গাড়ি সাধারনত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই ব্যবহার করে। অন্ধকারের কারণে গাড়ির লেখা পড়তে পারিনি। তবে মাইক্রোবাসের ভেতরের মৃদু আলোয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বেশকজনকে বসে থাকতে দেখেছি। তাদের কথাবার্তা ছিল গোছালো। তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলেই আমার মনে হয়েছে। মায়া বলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তরা থানা ও র্যাব-১ এ যোগাযোগ করি। র্যাব-১ এ আমাকে বসিয়ে রেখে বলা হয় একটা লিখিত আবেদন রেখে চলে যেতে, তারা পরে দেখবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন তারা যদি তখনই উদ্যোগ নিতো তবে হয়তো আমার স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হতো।
সোলায়মানের পরিবারের অন্য সদস্যরা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তাদের মুঠোফোনে সুন্দর কণ্ঠে ও শুদ্ধ ভাষায় একের পর এক হুমকি আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আওয়ামী লীগের কাউকে জড়িয়ে মামলা না করার জন্য বলা হচ্ছে। যদি তা করা হয় তাহলে পরিবারের কাউকে বাঁচতে দেবে না বলে জানিয়েছে হুমকিদাতারা। অপহৃত ও নিহত সোলায়মানের স্ত্রী সালমা ইসলাম মায়া বলেন, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বাসার গেটে সারাক্ষণ তালা দিয়ে রাখা হয়। ভয়ে এখনও হত্যা মামলা করিনি। অপহরণের পর উত্তরা থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে একটি অপহরণের মামলা করেছিলাম। এ পর্যন্তই। পুলিশও মামলার জন্য ডাকেনি। স্বামীকে বাঁচাতে সরকারের মন্ত্রী, র্যাব, ডিবি, মহানগর পুলিশ লক্ষ্মীপুরের পৌর মেয়রসহ নানা জায়গায় ধরনা দিয়েছি। কেউ পাত্তা দেয়নি। সোলায়মানের স্ত্রী বলেন, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও লক্ষ্মীপুর জেলার চরশাহী ইউনিয়নের তিতারকান্দি গ্রামের সেলিম বাহিনীর প্রধান সেলিম মিয়া ওরফে নিশাত সেলিম ও নেয়াখালীর ব্রহ্মপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন বাবলু ও নান্নু মিয়ার সঙ্গে সোলায়মানের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল দীর্ঘদিন ধরে। অপহরণের আগেও সেলিমের পরিচয়ে খোকন নামে একজন সোলায়মানকে বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়েছে। সেই হুমকির কথোপকথনের রেকর্ড আমার কাছে আছে। মায়া বলেন, সোলায়মানের লাশ পাওয়ার পর সেখানকার স্থানীয় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কয়েকজন নেতাসহ আবদুল মান্নান ও খোকন আমার মৃত স্বামীর লাশে জুতা দিয়ে পিটিয়েছে। মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেছে। হাজার হাজার মানুষের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। একজন মানুষ কতটুকু নির্মম হলে মৃত মানুষের শরীরে আঘাত করতে পারে ভাবা যায়! তিনি বলেন এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তাতে এ বিষয়ে আমার মনে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই যে, লক্ষীপুর জেলার আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকর্মীরাই আমার স্বামীকে অপহরণ ও হত্যা করেছে আর তাদের সহযোগিতা করেছে র্যাব। সোলায়মানের পরিবারের একজন সদস্য জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সোলায়মানকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। কারণ সোলায়মানকে অপহরণের পর থেকেই সাদা পোশাকধারী কিছু লোক আমাদের পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করেছে। সোলায়মানকে উদ্ধারে আমরা যখন যেখানে গিয়েছি সেখানেই তারা আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেছে। তাদের বেশভূষা দেখেই আমরা বুঝতে পেরেছি তারা একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। পরিবারের আরেক সদস্য জানান, নারায়ণগঞ্জে অপহরণের পর ৭ জনকে হত্যার পর আমাদের মনে হচ্ছে সোলায়মানকেও নির্যাতন করে প্রথমে দুর্বল করার পর গুলি করে হত্যা করা হয়।
এদিকে উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের করা মামলার বিষয়ে থানার ওসি শাহাদাৎ হোসেন খান জানান, সোলায়মান অপহরণ ও হত্যা মামলায় তদন্ত করা হচ্ছে। পুলিশ এখনও কোন ক্লু পায়নি। তার সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল কিনা এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এ মামলার তদন্তে অগ্রগতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাকির হোসেন জানান, হত্যা ঘটনার ক্লু খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত কোট মোটিভ পাওয়া যায়নি। তথ্যসূত্রঃ মানব্জমিন