বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা চেতনার মূল ভিত্তিকে গুড়ো গুড়ো করে দেওয়া হচ্ছে

মুস্তাফা জামান: বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের ক্লাস ৯-১০ এর বাংলা বইয়ে একটি কবিতা সংযুক্ত করা হয়েছে, কবিতার নাম: ‘সাঁকোটা দুলছে’, লেখক- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা মূল থিম ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় দুটো কিশোরের বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার কষ্ট। কবিতার শেষে বইয়ের ২৩৬ পৃষ্ঠায় দুটি উদ্দীপক আছে। আসুন, উদ্দীপক দুটো পড়ি-
প্রথম উদ্দীপক:
শিহাব সেনগ্রাম মিডল স্কুলে পড়তো। বহাদুরপুর, মেঘনা, বাগমারা, সেনগ্রাম পাশাপাশি গ্রাম ছিলো । গ্রামের হিন্দু-মুসলমান শিক্ষার্থীরা হাসি-আনন্দে স্কুলে যেতো। ১৯৪৬ সালে দেশভাগ হলে শিহাব দেখতে পেলো তার হিন্দু সহপাঠীরা ভারত চলে যাচ্ছে। দেবব্রতের সঙ্গে বন্ধুত্বের স্মৃতি শিহাব ভুলতে পারে না। স্কুলের সামনের বরই গাছ থেকে বরই পাড়ার স্মৃতি ৭০ বছর বয়সেও শিহাব বিস্মৃতি হয়নি।
দ্বিতীয় উদ্দীপক:
ঋত্বিক কুমার ঘটক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। তার অধিকাংশ চলচিত্রে দেশভাগের যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। নিজের জন্মস্থানে যেতে হলে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে এই বেদনা তার মতো অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। এ কারণেই তিনি বলতেন, ‘বাংলার ভাগ করিবার পারিছ, কিন্তু দিলটারে ভাগ করবার পারো নাই”
পাঠক এ কবিতার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়া ১৯৪৭ সালের দেশভাগ মোটেও উচিত হয়নি, রাজনৈতিক কারণে কষ্ঠের ভাগিদার হতে হয়েছে হিন্দু-মুসলমানদের। উল্লেখ্য কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ পাওয়া সিনেমা ‘রাজকাহিনী’ও একই শিক্ষা দিয়েছিলো। আর সেই রাজকাহিনীর শিক্ষা এখন চলছে বাংলাদেশর পাঠ্যপুস্তকে।
আসলে এ কবিতাটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর তা বোধকরি এখনও কেউ অনুধাবন করে নাই। এই কবিতাটি হচ্ছে এক প্রকার ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল, যার মাধ্যমে বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনতা চেতনার মূল ভিত্তিকে গুড়ো গুড়ো করে দেওয়া হচ্ছে। কারণ-
পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান নামে যদি কোন দেশ না সৃষ্টি হতো, তবে বাংলাদেশ নামক দেশও সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশ তখন হতো ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের নাম। তাই ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক সমপরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৪৭ এ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি। এ কারণে ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশে সৃষ্টিতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তারাই কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন। যেমন বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী, ভাস্নাী সবাই ছিলেন দেশভাগের অন্যতম নেতা। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছিলেন- “পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কি হবে? …অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম” । (সূত্র: বঙ্গবন্ধু লিখিত “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”) অর্থাৎ ১৯৪৭ এ দেশভাগ হেয় করে কবিতা রচনার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাণপুরুষদের দীর্ঘ সংগ্রামকে অস্বীকার করা। তাই যদি ১৯৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সুখ-দুঃখ নিয়ে কবিতা লিখতেই হয়, তবে ১৯৭১ কে নিয়েও একই ধরনের কবিতা লিখতে হবে। কারণ ঐ সময় অনেক বাংলাদেশী-বিহারীর মধ্যে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিলো।
মূলত: ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশেীদের মধ্যে প্রচার করে যাচ্ছে- ১৯৪৭ এ হিন্দু-মুসলিম ভাগ হওয়া ঠিক হয়নি। উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানো। এ কারণে কিছুদিন আগে ভারতের দেব নামক এক অভিনেতা এসে বলেছিলো – “দাও দুই বাংলা এক করে দাও”। এখন ঐ তত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শেখানো হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। অথচ ’৪৭ এর দেশভাগকে অস্বীকার করা মানে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা এবং এক কথায় বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে মেনে নেওয়া। দেখা যাবে, এই কবিতার পড়ার কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজেরাই বলবে- “৪৭ এর দেশভাগ ভুল ছিলো, দাও দুই বাংলা এক করে দাও।”