নাটককে আমি নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি-রওশন আরা মনির রুনা

DSC_0881সম্মিলিত নাট্যপরিষদের পরিচালক রওশন আরা মনির রুনা সিলেটের আলোচিত ও প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব। ছড়া, আবৃত্তি থেকে নাট্যাভিনয় তাঁর জীবনের এক বিশেষ অংশ। অভিনয় জগতে পার করেছেন প্রায় চারযুগ। বাংলাদেশ বেতার, মঞ্চ, ভিজুয়্যাল, যাত্রাপালা, পথনাটকে নিজেকে আপন মহিমায় প্রজ্বলিত রেখেছেন এই নারী। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে এবং দেশের অনেক জাতীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সাথে। মঞ্চের তুখোড় এ অভিনেত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সৈনিক মো. সাইদুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং বিশিষ্ট নাট্যকার মো. মনির আহমদের স্ত্রী। গতকাল শুক্রবার রাতে তিনি দাড়িয়াপাড়ার বাসায় মুখোমুখি হন দৈনিক সবুজ সিলেটের ‘আয়না’র।
নাটক, সংসার, জীবনের সুখ-দুঃখ ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন রওশন আরা মনির রুনা। গল্পের ফাঁকে ওঠে আসে কীভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে সম্মানীয় হয়ে আছেন; কীভাবে নিজে ভালোবাসেন নাটককে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল হক শিপু।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। দৃশ্যে ঘসেটি বেগমকে ডাকছেন সিরাজউদ্দৌলা। ঘসেটি বেগম মঞ্চে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সারা শরীর ভেজা। জাঁহাপনা বলে ডাকলেন সিরাজউদ্দৌলাকে। সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফা বললেন, এ কি ঘসেটি বেগম, তুমি যে দেখছি ভিজে এসেছ? মঞ্চে উপস্থিত ঘসেটি বেগমের চরিত্রে অভিনেত্রী ছিলেন হতভম্ব। তিনি কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তাঁকে সংলাপ ধরিয়ে দিলেন সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী চরিত্রের অভিনেত্রী রওশন আরা মনির রুনা। ঘসেটি বেগম বললেন, জাঁহাপনার ডাক শুনে থরথর করে কেঁপে নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম।
আসলে নাটক চলাকালে মঞ্চের বাইরে অনাকাক্সিক্ষত এক ঘটনায় নদীতে পড়ে ছিলেন ঘসেটি বেগম চরিত্রের অভিনেত্রী। সিরাজউদ্দৌলা যখন ঘসেটি বেগমকে মঞ্চে ডাকেন, তখন তাঁর স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করছিলেন সিলেটের পরিচিত অভিনেত্রী রওশন আরা মনির রুনা। তখন তিনি উপস্থিত জ্ঞান খাঁটিয়ে ঘসেটি বেগমকে অভিনয়ে ফিরিয়ে এনে দর্শকদের করেছিলেন বিমোহিত। তিনি শুধু যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন এমন নয়; তাঁর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে প্রায় ৭শ’ মঞ্চ নাটক। অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ বেতারে তিনশয়ের অধিক নাটকে। তিনটি চলচ্চিত্রে এবং ভিজুয়্যাল নাটক করেছেন শতাধিক। ইশিতা টেলিমিডিয়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অভিনয় করছেন। মঞ্চের নন্দিত এ অভিনেত্রী এখনও গ্রুপ থিয়েটারের একজন কর্মী।
রওশন আরা মনির রুনা গোলাপগঞ্জ উপজেলার কুশলী গ্রামে ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমানের অনুপ্রেরণায় নাটকে প্রবেশ করেন ছয় বছর বয়সে। প্রায় চারযুগ ধরে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন নাটকের সাথেই। ছড়া, আবৃত্তি থেকে নাটক তাঁর জীবনের একটি বিশেষ অংশ। সেই বিশেষ অংশ আরো বেশি ধারালো হয়ে ওঠে গুণী নাট্যকার মো. মনির উদ্দীন আহমদের সংস্পর্শে। কৈশোরে তিনি জড়িত হন দীপালী নাট্যসংগঠনে। এখানে কাজ করার ও শেখার সৌভাগ্যে হয় তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি মনির উদ্দীন আহমদকেই জীবনসঙ্গী করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে এবং ব্যক্তিগত জীবন ও সুখী পরিবার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। স্বামী মনির আহমদ নাট্যচর্চার পাশাপাশি করতেন সরকারি চাকরি। যাঁর হাত ধরে রওশন আরা মনির রুনা আসেন আজকের অবস্থানে। রুনা একাধারে একজন শিল্পী ও সমাজকর্মী। বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রে ‘কৃষানি’ ও ‘শ্যামল সিলেট’ এবং এসটিভিতে করছেন নিয়মিত অভিনয়। বেতারে এ প্লাস অভিনেত্রী চাকরিও করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কাজল শাহ সমাজ কল্যাণ সংস্থার পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রকল্পের মাঠকর্মী ছিলেন। ১৯৮০ সালের মে মাস থেকে যুক্ত হন এসএসকেএস পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রকল্পে। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পালন করেন এ দায়িত্ব। এরপর ইপিআই কর্মী হিসেবে কাজ করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ৩০ বছর আগে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সিলেটের ডাক্তার সেবিকারা বক্তব্য রাখতে যখন ভয় পেতেন, তখন তিনি কাজ করেছেন দ্রুততার সাথে। মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন, ছোট পরিবারের মূল্যবোধ এবং মা ও শিশুকে সুস্থ রাখার প্রক্রিয়া।
১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন রুনা। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেট শিল্পকলা একাডেমি ও বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন অসংখ্য নাটকে। অভিনয় করে স্বর্ণপদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। অর্ধশতাধিক সম্মাননা ক্রেস্ট পেয়েছেন উপহার।
অভিনয় সম্পর্কে রওশন আরা মনির রুনা বলেন, এখন অভিনয় আমার জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। আমি অভিনয়কে আমার সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ বেতারে অভিনীত তিনশয়ের অধিক এবং ৩শ ৮৯টি জীবন্তিকায় অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালে সিলেটের মাটিতে পথনাটকের যাত্রা শুরু হয়। শুধু তাই নয়; তিনি রবিঠাকুরের ‘সমাপ্তি’, ‘বড়দি’, ‘মেজদি’ নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘বিবিসাব’ নাটকে ১২১ টি প্রদর্শনীতে অভিনয় করে সিলেটের ‘বিবিসাব’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। একই নাট্যকারের ‘এখন ক্রীতদাস’ নাটকে ১৫৬ টি প্রদর্শনী, ‘তোমরাই’ নাটকে ১০১ বার এবং ‘মেরাজ ফকিরের মা’ মঞ্চ নাটকের ৩০টি প্রদশনীতে অভিনয় করেন। বিশিষ্ট নাট্যকার শাকুর মজিদের মতো গুণী নাট্যকারের ‘নাইওরী’, ‘লন্ডনী কইন্যা’ ও ‘বৈরাতি’ নাটকে অভিনয় করে সারা দেশের দর্শকদের নজরে আসেন।
শিশুশিল্পী হিসেবে অসংখ্য মঞ্চ নাটকে অভিনয় করলেও ১০ বছর বয়সে ‘কুয়াশা কান্না’ মঞ্চ নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। ইশিতা টেলিমিডিয়ার তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে, ‘রাধা’, ‘কান্দিছ নারে জাদ’ু, ‘একজন জাদু’, ‘লন্ডনে জাদুর ঈদ’, ‘ইচ্ছা’, ধারাবাহিক চারশ’ পর্বের নাটক ‘নিঠুর লন্ডনী’, দুইশ পর্বের ‘ঘরে বাইরে’, সম্প্রতি আলোচিত নাটকের মধ্যে ‘রাজন হত্যা’ এবং ‘আমারে বাঁচাও’ নাটক দর্শকদের আরো কাছে নিয়ে যায় রুনাকে।
রওশন আরা মনির রুনা বলেন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যত নাটক পরিবেশনা করা হয়, সবকটিতেই তিনি অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ‘ঝুঁকি’ ও ‘পাগলা ঘন্টা’ উল্লেখযোগ্য।
বাবার প্রেরণায় নাটকে প্রবেশের পর সহযোগিতা পান স্বামী মনির উদ্দীন আহমদ, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র অভিনেতা মরহুম রুহুল আজাদ চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যকার নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না, নাট্যকার মরহুম মুমিন উদ্দিন সুরুজ, শিবু ভট্টাচার্য, রানা বর্মণ, মোস্তফা কামাল, দুলু, অর্পণা মকসুদসহ অনেকের।
বাংলাদেশের গুণী শিল্পীদের মধ্যে আলী জাকের, সারা জাকের, এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদী, রাইছুল ইসলাম আসাদ, শমি কায়সার, তৌকির আহমেদ, বিপাশা হায়াৎ, জাহিদ হাসান, তারিন, সাজুসহ অনেকের সাথে অভিনয় করেছেন সিলেটের এ গুণী অভিনেত্রী।
নাটক নিয়ে আন্দের কাহিনি বলতে গিয়ে রওশনারা মনির রুনা সাক্ষাৎকারের শুরুর গল্প করেন। বলেন, গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বরে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মঞ্চের উল্লিখিত ওই গল্প। আর জানিয়েছেন সবচেয়ে আনন্দ পান, যখন দর্শর্কের ভালোবাসায় সিক্ত হন।
নাটক জীবনে দুখের কাহিনির কথা বলতে গিয়ে কান্নজড়িত কন্ঠে অভিনেত্রী রওশন আরা মনির রুনা বলেন, ‘জগন্নাথপুর একটি মঞ্চ নাটক করতে যাই। রাতে নাটক মঞ্চস্থ হবে। রাত ৮টার দিকে খবর গেল, আমার প্রিয় নানি মারা গেছেন। অভিনয় করেই বাড়ি ফিরি। বাড়িতে এসে দেখি নানির নিথর দেখ খাটিয়ার রাখা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে আমার মেয়ের জন্ম হয় সিজারে। ওর জন্মের ৯ দিনের সময় আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়। নাটক ‘কৃতদাসে’ রিহারসেল না করেই অভিনয় করি। এ দিনগুলো ভুলার নয়। তারপরও এই নাটকই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নাটককে যে আমি নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। নাটকই আমার জীবন। উচ্চমাত্রার ডায়বেটিস নিয়েও আমি মঞ্চে অভিনয় করেছি।
তিনি বলেন, যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন আমি শিশুশিল্পী। তখন রাজাকাররা বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠান করত। কেউ জানত না কারা অনুষ্ঠান করাচ্ছে। আমি একটি রুটি ও মুগডাল খেতে অনুষ্ঠানে চলে যেতাম। পরে ঘরে ঢুকে খেতে হতো মায়ের পিটুনি। পরে মায়ের কাছ থেকে জানলাম, যারা অনুষ্ঠান করছে তারা রাজাকার। এরপর আর কোনো দিন তাদের অনুষ্ঠানে যাইনি। পরে মা আমাকে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত থেকে শুরু করে তাঁর সিনিয়র এমন কেউ নেই যারা আমার সঙ্গে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেননি।
রওশন আরা মনির রুনা দুই সন্তানের জননী। ছেলে তপু যুক্তরাজ্যে ও মেয়ে উর্মি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ৫ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রুনাই সবার বড়। রওশনারা মনির রুনার তিন বোন ও দুই সন্তান নাট্যকর্মী। রুনা নাটকে অভিনয় করার সুবাদে নিজে যুক্তরাজ্য ও কলকাতায় গেছেন একাধিকবার। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন নাট্যায়ন সিলেটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সদস্য সিলেটে কাজ করছেন। নাট্যায়নের হয়েই চার শতাধিক মঞ্চ নাটক করেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি এ সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।