গান পাগল এক দোলনের কথা -জীবন পাল

জীবন ও জীবিকা – (পর্ব-৬)

DSC_0003  rr11পুরো নাম দোলন দত্ত। যার বয়স এখন পঞ্চাশ এর কোঠায়। হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং এর যাত্রাপাশা গ্রামে যার জন্ম। পিতা: মৃত যোগেন্দ্র দত্ত ও মাতা: মৃত উষা রানী দত্তের ৪র্থ সন্তান দোলন। ৫ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে ৩য় । বাল্যকাল ও শৈশবের প্রায় পুরোটা সময় দোলনের অতিবাহিত হয় নিজ গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই গান পাগল ছিল দোলন। ৬ বছর বয়স থেকেই নিজের কন্ঠে মাতোয়ারা করতে থাকে তার কন্ঠের পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালীর গান। এসব গান দিয়ে বানিয়াচং এলাকার মানুষের মন কেড়ে নেই সেই ছোট্ট দোলন। এসব গানে মাতোয়ারা গান পাগল বানিয়াচংবাসী অধীর আগ্রহে বালক দোলনের গান শুনতো। বানিয়াচং এলাকার বিভিন্ন জাতীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের মঞ্চে ডাক পড়তো বালক দোলনের। কিশোর বয়সে দোলন গ্রামের যাত্রাপালার মঞ্চেও ছড়িয়ে দিয়েছিল তার কন্ঠের যাদুকরী সেই সুর। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যে সুরে মাতোয়ারা ছিল বানিয়াচংবাসী তখনকার অনুষ্ঠানে আগত গানপ্রেমী ভক্তরা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বদলে যায় দোলনের পরিস্থিতি ও আশেপাশের দৃশ্যপট। সংসারে অভাব নেমে আসায় গান পাগল দোলনের বাউরুলের জীবনের ইতি ঘটে। জীবিকার তাগিদে বড় ভাইয়ের সাথে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরে। গ্রাম্য পরিবেশে বড় হওয়া সহজ-সরল দোলন ইট-কাঠের মত শক্ত শহুরে জীবনের জীবন সংগ্রামে সামিল হয়। বড় ভাইয়ের কাতারে আশ্রয় মিলে তার। বড় ভাইয়ের দোকানে বড় ভাইকে সহযোগিতা করাটা পরিনত হয় তার নিত্যদিনের কর্তব্যকর্মে। কিন্তু গান পাগল দোলনের কণ্ঠের গান যেন দমে থাকার নয়। কাজের মধ্যে যেভাবে সব সময় তার কন্ঠে গুন গুন সুরে গান ভেসে বেড়াতো তেমনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই শহরের বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠানের মঞ্চে মাক্রোফোন হাতে নির্ভয়ে গান গাইতে দেখা যেত তাকে। বিধাতা খুব বেশিদিন দোলনকে এই শহুরের মঞ্চে গান গাইতে দিলনা। ভাইয়ের বাধ্যবাধকতায় পরিবারের স্বচ্ছলকা ফিরিয়ে আনতে দোলনকে পাড়ি দিতে হলো দেশ ছেড়ে দেশান্তরে। গ্রামের গান পাগল সেই দোলনকে হতে হলো দেশান্তরী। ১৯৮৯ সালের ১৭ জুন। দোলনের বাবা, মা ও মেঝো ভাই ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দোলনকে বিদায় জানায় । বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫ টায় । এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সে জীবনে প্রথম বারের মত উড়োজাহারজ উঠে আকাশে উড়টর স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেয় দোলন। ঢাকা থেকে প্রথমবারের মত দোলনকে নিয়ে উড়াল দেওয়া এয়ার এন্ডিয়ার সেই উড়োজাহাজটি কলকাতা,বোম্বে, কাতারের দোহা বিমান বন্দর হয়ে দোলনকে পৌছে দেয় মরুভূমির দেশ বাহরাইনের মহাররক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে । গ্রামের সেই দোলন তখন নাম লেখায় প্রবাসীদের খাতায়। বাহরাইনের আরাদ ফিসিং কেইসেস নামক এক নেট প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টারিতে চাকুরী হয় তার। যেখানে চুক্তির ভিক্তিতে নেট তৈরি করে চলে জীবনের তাগিদে তার জীবিকা নির্বাহ। ফ্যাক্টরীর বাইরে খোলা আকাশের নিচে শুধুমাত্র মাথার উপরে টিনের ছাউনী দেওয়া স্থানেই যাকে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে টানা ২ বছর। অতিবাহিত কষ্টে আবৃত সেই মুহুর্তকে আনন্দ করে নিতে তার কন্ঠে ভেসে বেড়াতো বাংলার সেই সব পরিচিত গান। গুন গুন সুরে তার কন্ঠে বাজতে থাকতো, “ হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ”, “আমি বন্দি কারাগারে” সহ এই প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গানগুলো। কষ্টকে আকড়ে ধরে সেখানে নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য এক রকম যুদ্ধ করে দিন যাপন করতে হয়েছে তাকে। অত:পর বাহরাইনে বসবাসরত কলকাতা প্রবাসীদের আয়োজনে মানামা শহরে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের দূর্গাপুজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাথের বাংলাদেশীদের সহযোগিতায় গান গাওয়ার সুযোগ পায় দোলন। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগায় দোলন। তার কন্ঠের সেই জাদুকরী সুর সেখানে উপস্থিত সবারই মন কেড়ে দিতে সক্ষম হয়। সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল কলকাতার বঙ্গীয় সমাজ। দোলনের গান বঙ্গীয় সমাজের মন জয় করে ফেলে। সেই থেকে কলকাতার বঙ্গীয় সমাজের আয়োজনে বাহরাইনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দোলনকে নিয়ে যেতো বঙ্গীয় সমাজের মেম্বাররা। এক পর্যায়ে সেখানকার উচ্চবিত্ত প্রবাসী বাংলাদেশীরা দোলনের খূঁজ পেয়ে দোলনকে আহ্বান জানায়। কেননা এর মধ্যে দোলন বাহরাইনের সকল শ্রেণীর মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল তার কন্ঠের জাদুকরী গান দিয়ে। দোলনের আগ্রহ ও বাহরাইনে দোলনের গানের ভক্ত দেখে দোলনকে নিয়ে বাহরাইনে বসবাসকারী বিভিন্ন পেশাজীবি ও সাংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশীদের সমন্বয়ে বাহরাইনে গড়ে তোললেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংগীতা শিল্পীগোষ্ঠী’। যেখানে দোলনকে দেওয়া হয় সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। নিজের দেশের মানুষের সমন্বয়ে নিজের সংগঠন, তাও আবার সাংস্কৃতিক সংগঠন এটা যেন দোলনের জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর ‘সংগীতা শিল্পীগোষ্ঠী’ রুপ নেই “বাংলােেদশ সোসাইটি”। এরপর সংগীতপ্রেমী গান পাগল দোলনকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কেননা চাকুরীর পাশাপাশি দোলন এখন বাহরাইনের একটি সংগঠনের সম্পাদক। এর সুবাদে ও ভাল শিল্পী হিসেবে ইন্ডিনিয়ান সহ বিভিন্ন দেশের কাবে ডাক পড়তো দোলনের। যার ফলে দোলনের আয়ের উৎসটা বৃদ্ধি পাওয়ায় কষ্টের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় দোলন। কিন্তু এর স্থায়িত্বটা বেশিদিন হয়ে উঠেনি। কেননা, দোলন পরিবার ও আত্মীয় প্রেমী স্বভাবের। এর মধ্যে মা প্রিয় সন্তান ছিল দোলন। যার ফলে দোলনের ঘুরে দাড়ানোর মুহর্তে তার আত্মার আত্মীয় জন্মধাত্রী মায়ের আহ্বানে সব কিছু ফেলে সাত-সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে পুনরায় ফিরে আসতে এক প্রকার বাধ্য হয় দোলন। ২০০৫ সালের নভেম্বরে প্রবাস জীবনকে ইতি জানিয়ে চিরচেনা বাংলাদেশে ফিরে এসে শ্রীমঙ্গলের সন্ধানী আবাসিক এলাকায় মা, বাবা, ভাই, বোনের সাথে সেই পূর্বের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে দিনযাপন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে দোলন হারিয়েছে তার মা-বাবা দুজনকে হারিয়েছে। প্রবেশ করেছে বিবাহীত সাংসারিক জীবনে। মৌলভীবাজার জেলার আতানগীরি গ্রামের কলি দত্তকে সারা জীবনের জন্য জীবনসঙ্গী করে কাছে টেনে নিয়ে ৮ বছরের একমাত্র মেয়ে দোলা দত্তকে নিয়ে যে দোলনের এখন পথচলা। তারুন্যের উজ্জ্বিবিত সেই দোলনের চেহারায় পড়েছে বয়স্কের ছাপ। এত ঘাত-প্রতিঘাত, জীবনের উঠা-নামা তবুও দমে নেই দোলন। আজও সে তার তারুন্যের সেই স্মৃতীমাখা দিনগুলো আগলে রেখে সেই দোলনের আঙ্গিকেই প্রতিনিয়ত গুন গুন করে গেয়ে যাচ্ছেন তার সুমধুর কন্ঠে হারানো সেই সব গানগুলো। যে গানগুলো জীবন্ত, অমর। মাঝে মধ্যে এখনকার তারুন্যকে আনন্দ দিতে তার সুরে ভেসে আসে এখনকার পরিচিত কিছু গানও। যদিও বয়সের তাড়নায় আজ দোলন এক প্রকার অবহেলিত। কিন্তু আজও সে তার কন্ঠে হারানো দিনের সেই সব অমর গানগুলো গেয়ে মাতিয়ে রাখতে চান সংগীতপ্রেমী মানুষদের। টিকিয়ে রাখতে চান হারানো দিনের হারিয়ে যাওয়া সেই সব অমর গানগুলোকে।