শাহজালালে তিন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রেডলাইন

8259_f1ডেস্ক রিপোর্টঃ হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় তিন ধরনের কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিটি)। ৩১শে মার্চের মধ্যে শুধু  তাৎক্ষণিক পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এখনও বাস্তবায়নের বাকি স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা। গত ১৩ই মার্চ ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্টের হেড অব এভিয়েশন সিকিউরিটি মার্টি জোনস স্বাক্ষরিত একটি চিঠি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়। ওই চিঠিতে তাৎক্ষণিক সুপারিশে বলা হয়, নিয়োগকৃত ঠিকাদার বিমানবন্দরে যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি বিমানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা তল্লাশির কাজ তত্ত্বাবধান এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য কর্মী আনবেন।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত ২১শে মার্চ শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে বৃটিশ কোম্পানি রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটি লিমিটেড। তাদের ২৯ জন কর্মী এরই মধ্যে নিরাপত্তা দেখভালের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট- এর স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিন থেকেই ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধান ও তল্লাশি-কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু করতে হবে। যাতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রয়োজনীয় মাত্রায় সক্ষমতা অর্জন করে। এতে করে ঢাকা থেকে ভ্রমণকারী সব যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই রেডলাইন শাহজালাল বিমানবন্দরের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মার্টি জোনসের চিঠিতে বলা হয়, আমাদের মূল্যায়নে চিহ্নিত দুর্বল জায়গাগুলোতে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির মান বজায় রাখা।

বিমান যাত্রী প্রবেশের পথে ও মূল তল্লাশি পয়েন্টে ইটিডি’র কার্যকরী ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য তল্লাশি পয়েন্টে সঠিক কর্মী সরবরাহ এবং হোল্ড ব্যাগেজ তল্লাশি ও পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। বিমানবন্দরের র‌্যাম্প এরিয়াসহ সব বিমানের কার্যকর পাহারা ও নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে কর্মীদের তল্লাশি, কার্গো তল্লাশি ও পাহারা দিতে হবে। কার্গো রাখার স্থানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ ও কার্গো কর্মীদের তত্ত্বাবধান এবং ফ্লাইটে সরবরাহ করা জিনিসপত্র ঠিকভাবে তল্লাশি ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। চিঠির শুরুতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের মূল্যায়নে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেশ কয়েকটি দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তব হুমকির বিরুদ্ধে উভয় দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, এটি মোকাবিলায় আমাদের (যুক্তরাজ্য) প্রধানমন্ত্রী অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞ ও সহায়ক ঠিকাদার আনতে আপনাদের (যুক্তরাজ্য) প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন। এতে বলা হয়, আপনাদের সমর্থ ও প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট রয়েছে। তাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তল্লাশি প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য স্বল্পমেয়াদে নিজস্ব প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করতে হবে ঠিকাদারদের। পাশাপাশি সাধারণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের প্রয়োগগত ও তত্ত্বাবধানমূলক প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে। তল্লাশি ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার জন্য তত্ত্বাবধানমূলক জনবল সরবরাহ করতে হবে। স্থানীয় কর্মী ও এ কার্যক্রমে জড়িত অন্যদের প্রশিক্ষণের জন্যও ওই জনবল প্রয়োজন হবে।

যে বিশেষ দিকগুলোতে ঠিকাদারদের নজর দিতে হবে, সে দিকগুলো নিয়ে তিনটি পদক্ষেপ ঠিক করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের বেঁধে দেয়া আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণ ও সেসবের স্থায়িত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তায় এগুলো প্রয়োজন বলে আমরা বিশ্বাস করি। বৃৃটিশ চিঠিতে মধ্যমেয়াদি কর্ম পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ঠিকাদারদের একটি টেকসই ও শক্তিশালী বিমান পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। একে সহায়তার জন্য থাকতে হবে প্রয়োজনীয় কাঠামো ও প্রক্রিয়া। শিকাগো কনভেনশনের অ্যানেক্স ১৭-এ উল্লিখিত আবশ্যকতার ওপর ভিত্তি করে এসব করা উচিত। এতে করে নিশ্চিত করতে হবে, আইএসও’র নির্দেশনা ব্যবহার করে ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রিকমেন্ডেড প্র্যাকটিসেস’ বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। বর্তমান হুমকি বিবেচনা করে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ, তল্লাশি ও অন্যান্য প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা নির্দিষ্ট করতে হবে। চিঠির শেষদিকে বলা হয়েছে, আশা করছি তাৎক্ষণিক ও স্বল্প মেয়াদি ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা শুরু হবে। কারণ চিঠিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে। আগামীতে আপনাদের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।

সরজমিন বিমানবন্দর
২১ শে মার্চ থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি রেডলাইন এভিয়েশন দায়িত্ব নিলেও এখনও নিরাপত্তা ঘাটতি রয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার এয়ারপোর্টে সরজমিনে গিয়ে নিরাপত্তা ঘাটতি চোখে পড়েছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে মাইকিং ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, সিভিল এভিয়েশনের টেকনিক্যাল জনবলকে এখন ট্রেনিং দিচ্ছে রেডলাইন। দায়িত্ব নেয়ার পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৩ জনের টিমকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা। রোববার থেকে আরেক টিমের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। বেবিচকের সদ্য দায়িত্ব নেয়া চেয়ারম্যান এহসানুল গণি চৌধুরী মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন, রেডলাইন দায়িত্ব নিয়েছে। তারা এখন আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটি করছে। নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখভাল করা শুরু করেছেন। মাত্র কিছুদিন হয় দায়িত্ব নিয়েছে। কিছুদিন গেলে সবকিছু দৃশ্যমান হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেডলাইনের ২৯ জন কর্মী দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। ২৪শে মার্চের মধ্যে তাদের কর্মীরা বাংলাদেশে এসেছে। বিশ্বের ৩০টি দেশের এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি উন্নয়নে তারা কাজ করছে।

সর্বশেষ সাইপ্রাস এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা উন্নয়ন সংক্রান্তকাজ পেয়েছে ওই কোম্পানি। গতকাল সরজমিনে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, আগের চাইতে নিরাপত্তা কিছুটা জোরদার করা হলেও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। বিমানবন্দর এলাকায় ঢুকতেই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একাধিক চেকপোস্ট থাকলেও সেখানে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হচ্ছে খুব কম। যে কেউ অনায়াসেই বিমানবন্দরের ক্যানপি এলাকায় পৌঁছে যেতে পারছেন। অনেকে যাত্রীদের সঙ্গে ক্যানপি গেটে উঠে যাচ্ছেন। দেখা যায়, বিমানবন্দরের দুই ক্যানপি গেটে অসংখ্য মানুষের ভিড়। বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনরা অপেক্ষা করছেন। গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন ৪-৫ জন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্য। গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত দুই ক্যানপির গেট ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট পরিচিত লোকজনের সঙ্গে অনেক সাধারণ মানুষ ক্যানপির ভেতরে ঢুকে পড়ছেন। কখনো কখনো জটলা হয়ে গেলে আর্মড পুলিশের সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

একই অবস্থা দ্বিতীয় তলার বহির্গমন ক্যানপিতেও। দ্বিতীয় তলায় যেতে দুই দিকের সিঁড়িতে তল্লাশি চৌকি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই তল্লাশি চৌকিও অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এখনও যে কেউ চাইলে ব্যাগ ভর্তি ‘বিস্ফোরক’ নিয়ে দোতালা পর্যন্ত উঠে যেতে পারবে। দোতালার বহির্গমনের সিঁড়িতে ভেহিক্যাল স্ক্যানিং মেশিনও নেই। নেই কোনো আর্চওয়ে। বিদেশগামী সেজে যে কেউ দোতালায় উঠে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এছাড়া নিচের ক্যানপির গেটগুলোতেও কোনো আর্চওয়ে বা ভেহিক্যাল স্ক্যানিং মেশিন নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা উন্নতি করার সঙ্গে এর পরিবেশও আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। ঢাকার বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থতার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখে ৩১শে মার্চের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছেন।

ওই চিঠিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাজনিত সমস্যার মূলে আছে প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মী এবং যথাযথ নজরদারির ঘাটতি। নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হলেও নজরদারি বাড়ানো ও ভেতরে-বাইরে শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করা যায় অনায়াসেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার এই তারিখ শেষ হলেও বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় উল্লেযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই লাগেজ পার্টি, দালাল, চোর-বাটপারদের আখড়া হয়েছে বিমানবন্দর চত্বর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, পরিস্থিতি আগের চাইতে কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য যেভাবে চাইছে সেরকম পরিবর্তন হয়নি। বৃটিশ প্রতিষ্ঠান বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন অর্থাৎ টার্মিনালের ভেতরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালো করছে। সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে। পুরো পরিবর্তন আনতে কিছুটা সময় লাগবে। বিমানবন্দরের বাইরের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অপর এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, অন্য দেশের বিমানবন্দরে কাউকে রিসিভ বা বিদায় জানাতে একজনের বেশি কেউ আসে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অচেনা না হলে কেউ বিমানবন্দরেও যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে একজন বিদেশ গেলে বা বিদেশ থেকে আসলে তার সঙ্গে অন্তত ৫-৬ জন সঙ্গী থাকে। এজন্য ভিড় সামলাতেও বেগ পেতে হয়। যেখানে সেখানে পার্কিং করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রে আসলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র ও দক্ষ জনবল রাখতে হবে। তাহলেই বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করা যাবে। এদিকে রেডলাইন এয়ারপোর্টের দায়িত্ব নেয়ার পরদিন দোতলার ক্যানপিতে বিশাল জটলা দেখা যায়। ব্যাগেজের নিরাপত্তা তল্লাশি করতে বিমানযাত্রীদের কারও কারও ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। ফলে যারা কম সময় নিয়ে এয়ারপোর্টে আসেন তাদের অনেককেই ঝামেলায় পড়তে হয়।