পরিবেশ দূষণ ভরাট দখল মরে যাচ্ছে সুরমা

1

নুরুল হক শিপু :: মহানগর সিলেটকে দুই ভাগ করেছে যে নদী তার নাম সুরমা। নদীর উপরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজকে কেন্দ্র করে নগরের একপাশে উত্তর সুরমা, অন্যপাশ দক্ষিণ সুরমা নামে পরিচিত। দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দয্য যুগ যুগ ধরে সুরক্ষা করে যাওয়া নদীর নাম সুরমা। এই নদী নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা ও গান। সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সিলেট শহর। যা এখন মহানগরে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই নদীটি এখন মরে যাওয়ার উপক্রম। কতিপয় অভিবেচক মানুষ সুরমা নদীকে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ৫২ বছর ধরে সুরমা নদীর পানিপ্রবাহ কমেছে সাড়ে ৯৭ ভাগ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী ২০ বছর পর হয়তো আর পানির দেখাই মিলবে না ঐতিহ্যম-িত সুরমা নদীতে। বার বার খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও রহস্যজনক কারণে খনন করা হচ্ছে না সুরমা নদী। দিন দিন ভরাটের কারণে হয়তো একদিন মরেই যাবে সুরমা। ভরাটের কারণে যেমন সুরমার পানি কমছে, তেমনি সিলেট নগরসহ আশপাশ এলাকায় পানির সংকট চরমভাবে দেখা দিচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে পানির স্তর কমছে। নতুন কোনো টিউবওয়েল বসানো হলে পানির স্তর পেতে হিমশিম খেতে হয়। ২০ বছর আগে যেখানে নতুন টিউবওয়েল বসালে  ৫০ থেকে ৬০ ফুটের মধ্যে পানির স্তর পাওয়া যেত। সেখানে  এখন ৩২০ ফুটেও বিশুদ্ধ পানির স্তর পাওয়া যায় না।
বিষয়টির সাথে একমত প্রকাশ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম সবুজ সিলেটকে বলেন, ‘সুরমা নদীকে আমাদের প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদীতে অবর্জনা ফেলা, নদী দখল করা, দীর্ঘদিন থেকে নদী খনন না করার কারণেই আজ সিলেটের মানুষ অল্পস্তরে পানি পাচ্ছেন না। ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে। তিনি বলেন, পানির স্তর কমে যাওয়ার আরো একটি কারণ হলো, রাস্তাঘাট পাকা অথবা আরসিসি করার পর পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় পানি নিচে যেতে পারে না। আর দ্বিতীয়টি হলো সুরমা নদী খনন না করা। সুরমাকে বাঁচাতে হলে সুরমার উৎসমুখ খনন করে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সিলেটে পানির সমস্যা সমাধান করতে হলে সুরমাকে বাঁচানোর বিকল্প নেই।’
এদিকে, দীর্ঘতম নদী সুরমার বর্তমান অবস্থা এমন শীতকাল এলেই নদীটি প্রায় শুকিয়ে যায়। জেগে ওঠে অনেক স্থানে চর। কোনো কোনো স্থানে নদীর বুকে শিশুদের ক্রিকেট খেলতেও দেখা যায়। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে তারপরও খনন করা হচ্ছে না। অপচনশীল পলিথিন এবং নগরের আবর্জনাও এখন ঠাঁই পায় সুরমার বুকে। সুরমা নদীকে এখন নদর্মায় পরিণত করা হচ্ছে।
একদিকে খনন না করায় সুরমা নদী ভরাট হচ্ছে, অন্যদিকে আবর্জনা ও অপচনশীল পলিথিনে সুরমার পানি হচ্ছে দূষিত। এর ফলে সুরমার পানি বর্তমানে মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এককালের খর¯্রােতা নদী সুরমার বুকে অনেক স্থানেই এখন পানি নেই। হারিয়ে গেছে নদীর নাব্যতাও। বছরের ১২ মাস যার বুকে ¯্রােতের কলকল ধ্বনি বহমান থাকত, তার বুক এখন ¯্রােতহীন। দখল, দূষণ আর দীর্ঘদিন খনন না করায় একসময়কার ¯্রােতস্বিনী সুরমা এখন যেন মৃত্যু পথযাত্রী।
দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাট, শাহজালাল ব্রিজের নিচ, গোলাপগঞ্জের বৈইটিকর এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুরমার বুক এখন শুকিয়ে গেছে। অনেক স্থানে পরিণত হয়েছে বিশাল মাঠে। আর নদীতে যতটুকু পানি রয়েছে তাতে মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করতে পারছেন। নগরের কিনব্রিজ এলাকা, কাজিরবাজার, ছড়ারপাড়, কিনব্রিজের দক্ষিণ পাশ, কদমতলি, বরইকান্দি, কুচাইসহ যেসব এলাকার পাশ দিয়ে বহমান সুরমা এসব স্থানে পানিও মানুষ ব্যবহার করতে পারছেন না। অপচনশীল পলিথিন, আর আবর্জনা ফেলার কারণে ওইসব এলাকায় পানি দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পানি ব্যবহার করার ফলে অনেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। নগরের বিভিন্ন এলাকার আবর্জনার ফেলতে ডাস্টবিন হিসেবে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সুরমা নদীকে। পলিথিনে সয়লাব এখন নদীগর্ভ। দূষণ আর পানিশূন্যতার কারণে সুরমায় নেই আগের মতো মাছও। বছরের বেশিরভাগ সময় সুরমার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন জেলেরা।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সুরমা নদী অনেক আগেই তার নাব্যতা হারিয়েছে। সুরমা নদী সিলেটের ঐতিহ্য। নদীটির খননকাজ করা হয়নি। খনন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আগে নদীতে আবর্জনা ফেলে পানি নষ্ট করা হয়েছে। এখন তা করা হচ্ছে না। নগরীর অবর্জনা এখন সিসিক কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ সুরমার পারাইরচকে ফেলছেন। তারাপরও সুরমা নদী কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। আগের মতো সুরমার মাছও পাওয়া যায় না। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরমা নদীর খনন কাজ করা দরকার।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, নদী খনন না করায় সুরমা নাব্যতা হারাচ্ছে। নদী খননের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই; খনন করতে উদ্যোগ নিতে হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে। সুরমা নদী সিসিকের যে সব এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, আমরা সেসব এলাকার আবর্জনা পরিষ্কার করি। এরপরও অনেকে অবর্জনা নদীতে ফেলেন। বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সিটি কর্পোরেশন তাদের সহযোগিতা করে।
সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কীম বলেন, আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উদযাপনে সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা যৌথভাবে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, সিলেটের প্রাণ সুরমা নদীর কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই গলা টিপে সুরমাকে হত্যা করছি।
সুরমা নদী আজ নিজের পরিচয় হারাতে বসেছে ।
কীম বলেন, সুরমা নদীর উৎসমুখ ভরাটের কারনে বরাক নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সুরমা নদী। সুরমার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫% পানি কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে সুরমার উৎসমুখ বরাক থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এর ফলে বরাক নদীর সমস্ত পানি এখন কুশিয়ারা নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তাই জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত সুরমা এখন মুমূর্ষু। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও পাহাড়-টিলা কাটার কারণে সুরমা নদীর উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সুরমা নদী খনন করে বাঁচাতে হবে। তা না করলে সিলেটের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।