মায়ের কোলে চড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে লিমা

limaডেস্ক রিপোর্টঃ স্বপ্নছোঁয়ার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে নড়াইলের পাঁচ প্রতিবন্ধী এসএসসি পরীক্ষার্থী। এদের কেউ শারীরিকভাবে পুরোপুরি সক্ষম না হলেও থেমে নেই তারা। স্বপ্ন তাদের আকাশছোঁয়া। এদের কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউ হাটতে পারে না, কারোর দুই হাত অপূর্ণ। এমন অদম্য পাঁচ শিক্ষার্থী এ বছর নড়াইলের তিনটি কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।

এর মধ্যে মায়ের কোলে চড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে লিমা খাতুন। লিমা নড়াইলের জুড়ালিয়া জেবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী। লিমা জানায়, তার ইচ্ছা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হওয়া এবং শিক্ষকতা করা।

লিমার মা পান্না বেগম বলেন, পরীক্ষার দিন লিমাকে কোলে করে নিয়ে পরীক্ষাকক্ষে বসিয়ে দিয়ে আসি এবং শেষ হলে আবার কোলে করে বাইরে আনি। জন্মগত ভাবেই হাত-পায়ে শক্তি নেই লিমার।

তিনি আরো জানান, তিন বছর বয়সে লিমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর অসহায় হয়ে পড়েন। স্বামীর ভিটেবাড়ি নড়াইলের রতডাঙ্গা গ্রাম ছেড়ে প্রতিবন্ধী লিমাকে নিয়ে বাবার বাড়ি (লিমার মামাবাড়ি) জুড়ালিয়া মহাজন গ্রামে চলে আসেন। নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। সেই থেকে হাঁস-মুরগি পালন করে সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি লিমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সহপাঠী সামিয়া খাতুন বলে, লিমা হাঁটতে পারে না, হাতেও শক্তি নেই যথেষ্ট। তবুও লেখাপড়ার প্রতি ওর (লিমা) অনেক আগ্রহ। হুইল চেয়ার এবং মায়ের কোলই লিমার একমাত্র ভরসা।

প্রতিবেশী নাদিরা বেগম বলেন, লিমা মামাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকলেও দারিদ্রতাই ওর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুড়ালিয়া জেবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসলেহ উদ্দিন জানান, অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও লিমা নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতো। সে পিএসসি এবং জেএসজিতে ভলো ফলাফল করেছে। লেখাপড়া ঠিকমত চালিয়ে যেতে পারলে লিমা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করছি।

এদিকে, নড়াইলের পলাইডাঙ্গা গ্রামের আদরী খানম দরিদ্র সংসারে কুপির আলোতে লেখাপড়া করে মিরাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি অপূর্ণ (জন্মগত) হাত দিয়ে অবিরাম লিখে যায় আদরী। হতে চায় সাংবাদিক।

আদরী বলে, আমি দেশের জন্য কাজ করতে চাই। সাংবাদিক হয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে ভালো খবর লিখতে চাই। ভালো খবর জানাতে চাই। আদরীর বাবা ইকবাল মিনা বলেন, লেখাপড়া প্রতি যথেষ্ট মন থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাবে আদরীকে লেখাপড়ার খরচসহ সবকিছু ঠিকমত দিতে পারিনি। দিনমজুর করে ছয়জনের সংসার চালান তিনি। আদরী ছাড়াও ছোট ছেলে রাকিব মিনা লেখাপড়া করছে চতুর্থ শ্রেণিতে। ভিটেবাড়িতে আট শতক জমি ছাড়া তাদের কোনো জমিজমা নেই।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাইফুল ইসলাম এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর (মুবারক হোসেন) সহযোগিতায়।

সাইফুল জানায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন খেলার এক সাথীর সাথে মাথায় আঘাত পেয়ে তার চোখে সমস্যা হয়। এরপর অনেক চিকিৎসা করিয়েও দু’চোখ ভালো হয়নি তার। সাইফুল আরো জানায়, রাইটারের (মুবারক) প্রশ্ন শুনে উত্তর বলে দিচ্ছে সে, আর মুবারক তার পরীক্ষার খাতায় লিখে যাচ্ছে। লেখাপড়া শেষ করে বড় কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা তার। সাইফুল তুলারামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থী। সাইফুলদের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। বাবা-মা এবং তিন ভাইয়ের সংসার তাদের। বাবা মোহাম্মদ হোসেন আলফাডাঙ্গা বাজারের মুদি দোকানি। বড় ভাই তানভীর ইসলাম রুবেল অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষার্থী এবং ছোট ভাই ফজলে রাব্বি শাহেদ প্রথম শ্রেণির ছাত্র।

আর জন্মগত ভাবে ডানহাত অপূর্ণ (ছয় ইঞ্চি) হলেও বাম হাত দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে দরিদ্র পরিবারের পিতৃহীন সন্তান লিটন মজুমদার।

লিটন জানায়, জন্মের তিন মাস পরে তার বাবা দুর্ঘটনায় মারা যান। লিটন ও তার মা উর্মিলা মজুমদার অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের খরচ যোগায়। চরমালিডাঙ্গা গ্রামের বিদ্যুৎ বিশ্বাসের ভিটায় বসবাস করেন তারা। লিটন জুড়ালিয়া জেবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে পরীক্ষা দিচ্ছে।

এদিকে, সাত বছর বয়সে খেলতে গিয়ে আহত হয়ে ডান চোখের দৃষ্টি হারায় নড়াইলের মুলিয়া গ্রামের মিতা বিশ্বাস। তবুও জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলেছে মিতা। মুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে মিতা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিতা জানায়, তার ইচ্ছা চিকিৎসক হওয়ার। মিতার মা ঝুনু বিশ্বাস বলেন, সাত বছর বয়সে খেলতে গিয়ে মাটিতে পড়ে চোখে আঘাত পায় মিতা। বাংলাদেশসহ ভারতে অনেক চিকিৎসা করিয়েও ভালো হয়নি তার চোখ। মিতার বাবা চিত্ত বিশ্বাস কৃষি কাজ করেন। ছোট বোন সেতু পঞ্চম এবং ভাই চিন্ময় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এ ব্যাপারে নড়াইলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন ‘ডিপিওডি’র সাবেক পরিচালক ছাব্বির হোসেন বলেন, জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা পাঁচ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবে বলে আশা করছি। উচ্চশিক্ষা লাভ করে তারা তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে-এই আমাদের প্রত্যাশা।

‘ডিপিওডি’র সভাপতি মাহাবুব আলম ও মাঠকর্মী নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজের বোঝা নয়, এর প্রমাণ দিয়েছে অদম্য মেধাবীরা। তাই লেখাপড়া শেষ করে ‘মানুষের মতো মানুষ’ হতে চায় তারা।