ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ: নির্যাতনেই মৃত্যু হাফেজ মাসুদের

62446ডেস্ক রিপোর্টঃ নির্যাতনেই মারা গেছেন হাফেজ মাসুদুর রহমান (২০)। এটাই সত্যি। সুরতহাল-ময়নাতদন্ত সবখানেই নির্যাতনে জর্জরিত শরীরের বিবরণ। তাকে নির্যাতনকারী কে? কার নির্যাতনে মরলো মাসুদ? তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না এখন।
মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ঘটনার পর থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের সম্মিলিত নির্যাতনে মাসুদ মারা গেছেন।
মাদরাসার সামনে এখনও ঝুলছে ‘শহীদ হাফেজ মাসুদুর রহমানের হত্যাকারী আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ হায়েনাদের ফাঁসি চাই,’ ‘হাফেজ মাসুদুর রহমান লাশ কেন? প্রশাসন জবাব দাও’- এমন স্লোগান লেখা নানা ব্যানার। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, মামলার এজাহারও লিখা হয়েছিল সেভাবেই। কিন্তু সেই মামলা ঘুরে যায়। বদলে যায় এজাহার। তাদের এজাহারে ২ পুলিশ কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ৩১ নেতাকর্মীর নাম দেয়া হয়েছিল।
এদিকে মাসুদুর রহমানকে হারিয়ে শোকে পাথর তার মা। তার বাসায় গেলে মিলে নীরব কান্নার শব্দ। মাসুদের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনায় মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা জানান, ওই রাতে (১১ই জানুয়ারি) হাফেজ বিভাগের সামনের মাঠে ছিল মাসুদসহ কয়েকজন ছাত্র। রাত ১১টায় পুলিশ সেখানে অভিযান চালালে মাসুদ দৌড়ে গিয়ে নির্মাণাধীন হেফজ বিভাগের ৪র্থ তলায় উঠেন। পুলিশও তাকে ধাওয়া করে সেখানে যায়। এরপর নির্যাতন করে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। রাত ৩টার দিকে মাসুদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে জানান।
এর আগে গুরুতর আহত মাসুদ কয়েক ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় এক বাসায় পড়েছিল। এসময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়নি। এর আগে মাসুদ আহত হয়েছিলেন বলে খবর জানতে পেরেছিলেন তার বড় ভাই। কিন্তু ১১টার পর মাসুদের ফোনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার আর কোন খবরই পাননি পরিবারের লোকজন। আহত অবস্থায় মাসুদের সঙ্গে কথা হয়েছিল কওমি মাদরাসা ছাত্রঐক্য পরিষদের নেতা খালেদ মোশাররফের।
খালেদ জানান, ঘটনার সময় আমি পাশের এক বাড়িতে ছিলাম। পরিস্থিতি শান্ত হলে সেখান থেকে আসি। তখন আহত ছাত্রদের দেখতে যায়। মাসুদকেও দেখে চলে আসার সময় সে আমার হাত টেনে ধরে। বলে “ভাই বাঁচার জন্য ওপরে উঠেছিলাম। আমার পিছে পিছে প্রশাসনের লোকজনও উঠছে। তারা আমারে লাঠি দিয়া বাইরাইছে, বুকের ওপর পারা দিয়ে ধরছে। বন্দুকের নল দিয়ে গুঁতা মারছে। গুলিও করছে। এরপর আমারে লাথি মেরে নিচে ফেলে দিলে আমি ছাদের ওয়ালে ধরে ফেলি। তখন বুট দিয়ে আমার হাতে পারা দিয়ে ধরে। এরপরই আমি নিচে পড়ে যায়। তারপর আর কিছু বলতে পারি না।”
মাসুদের সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, বুকের বাম পাশে থেঁতলানো জখম এবং বাম কাঁধে কালো দাগ পরিলক্ষিত হয়। ডান হাতের তালুতে সামান্য জখম আছে। পেটের নিচে বাম পার্শ্বে কালো সামান্য জখমের চিহ্ন দেখা যায়।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, তদন্তকালে ও বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে বর্ণিত আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। মাসুদের লাশের ময়নাতদন্ত করে ৪ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড।
এই বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মাসুদের বাম পাঁজরের ৪ নম্বর হাড্ডি ভাঙা ছিল। তার ফুসফুস ফেটে গিয়েছিল। বাম পাশের কটি ভাঙা ছিল। ডান পা এর হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত চামড়া ছোলা জখম ছিল। বুকের ওপর থেঁতলানো জখম ছিল। পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়ে সেটি ফুসফুসে আঘাত করে। এতে ফুসফুস ফেটে যায়। তবে তার শরীরে কোন গুলির আঘাত ছিল না বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী বোর্ডের সদস্য ডাক্তার রানা নূর শামস।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের রিপোর্টে বলেছি এসব জখমের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তদন্তকারী সংস্থাই খুঁজে বের করবে কারা তাকে নির্যাতন করেছে বা কিভাবে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
মাসুদের মৃত্যুর জন্যে শুরু থেকেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দায়ী করে আসছিলেন। তারা সেভাবে এজাহারও লিখেছিলেন। কিন্তু সেই এজাহার গ্রহণ না করায় অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দেয়া হয়। কিন্তু তাদের মূল এজাহার যেটি সেখানে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছিল ৩১ জনকে। আর অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছিল ৪০০-৫০০ লোককে।
জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার শিক্ষক আবদুর রহিম কাশেমী ও মাওলানা আবদুল হক বলেন, আমরা নাম দিয়েই মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু থানা থেকে বলা হলো এভাবে মামলা দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে। আসামি দিয়ে মামলা করা যাবে না। আমরাই আসামি চিহ্নিত করে ধরবো। পরে ১৫ই জানুয়ারি গভীর রাতে (রাত আড়াইটায়) সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সদর মডেল থানায় মাসুদ হত্যা মামলা দেয়া হয়। মামলার বাদী হন মাদরাসার শিক্ষা সচিব মুফতি শামসুল হক।
মামলার এজাহারে বলা হয় অজ্ঞাতনামা আসামিগণ দা, লাঠি, লোহার রড, পিস্তল ককটেল, হাতবোমা, ইটপাটকেলসহ ঘটনাস্থলে এসে দেশের প্রাচীনতম দ্বীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসা মসজিদের গ্লাস ভাঙচুর করে এবং তাণ্ডব চালিয়ে ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে মাদরাসার পূর্ব দক্ষিণ পাশে হেফজ বিল্ডিংয়ে ডুকে মারপিট করে সাক্ষীদের (মাদরাসা ছাত্র) জখম করে। ঘটনার এক পর্যায়ে অজ্ঞাত আসামিগণ হেফজখানার বিল্ডিং থেকে বের হয়ে মাঠের পূর্বদিকে নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে ককটেল, হাতবোমা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে মাদরাসার ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে। এতে মাদরাসার ছাত্ররা জখম হয়। মৃত মাসুদুর রহমানকে ৪ তলার ফ্লোর থেকে ফেলে দেয়। অজ্ঞাতনামা আসামিরা দা এর উল্টা পিঠ দিয়ে খুন করার উদ্দেশ্যে মাসুদর রহমানকে কপালের ডান পাশসহ সমস্ত শরীরে আঘাত করে জখম করে। একপর্যায়ে তাকে খুন করার উদ্দেশ্যে ৪তলা থেকে ফেলে দেয়। এরপর অজ্ঞাতনামা আসামিরা তাণ্ডব চালিয়ে মসজিদের গ্লাস, টেবিল চেয়ার ও হেফজখানার মালামাল লুটপাট করে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করে। প্রথম এজাহারের বর্ণনায় বলা হয়েছিল ১ ও ২নং আসামি সরকারি উছৃঙ্খল কর্মকর্তা। তারা বেপরোয়া। আর ৩ থেকে ৩১ নম্বর আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা চিহ্নিত খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ ও বোমাবাজ। ঘটনার তারিখে (১১ই জানুয়ারি) ১ ও ২নং আসামির নেতৃত্বে সকল আসামি দা, লাঠি, লোহার রড, পিস্তল, ককটেল, হাত বোমা, ইটপাটকেলসহ ঘটনাস্থলে আসে। তারা মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ, হাতবোমা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে জয়বাংলা ও মৌলবাদ নিপাত যাক স্লোগান দিয়ে শত বছরের ঐতিহ্য দেশের প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে। এ এজাহারে মাসুদের ওপর হামলার বর্ণনায় বলা হয়, ২নং আসামি (একজন পুলিশ কর্মকর্তা) পিস্তল দিয়ে কোমরের বাম পাশে গুলি করে এপার-ওপার ছিদ্র করে দেয়। ৩নং আসামি (ছাত্রলীগের সাবেক নেতা) দায়ের উল্টো পাশ দিয়ে কপালের বাম পাশে আঘাতে জখম করে। এভাবে বাকি আসামিরা বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে মাসুদের শরীরে আঘাত করে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এ এজাহারে ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য, জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাসহ মোট ৩১ জনের নাম আসামির তালিকায় দেয়া হয়েছিল। বাদবাকিরাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এম এ মাসুদ বলেন, মাসুদুর রহমান নির্যাতনে মারা গেছে। কিন্তু তা কিভাবে হলো সেটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। অন্যান্য সংস্থাও তদন্ত করে দেখছে। আর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যেভাবে মামলা দিয়েছেন আমরা সেভাবেই মামলা নিয়েছি।