নতুন পে-স্কেলে প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকরা বঞ্চিতই রইলেন !

swapon talukdarস্বপন তালুকদার: শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রচলিত আমাদের সমাজে। আসলেই কি শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে?কতটা সম্মানজনক শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই তা অনুভব করতে পারি, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াতে। একটা ঘটনা বলি। ঘটনাটা হলো এমন: মাছ কিনতে গেছি। মাছ বাজারের আমি প্রায় প্রতিটি দোকানের মাছ দেখি, দেখতে হয়, দর কষাকষি করি,করতে হয়। অনেক দোকানিই যে বিরক্তি বোধ করেন তা বুঝতে পারি। তারপরও উপায় নেই। একবার হলো কি, একটি মাছ কিনতে দর কষাকষির এক পার্যায়ে দোকানি বিরক্ত হলে বলল, আপনি কি করেন? পেশাটা জানার পর ঠাট্টা ও অবজ্ঞা মিশ্রিত সুরে যা শুনালেন হুবহু মনে পড়ছে না।তা হলো একটু আগে এক সরকারি কর্মচারি একই মাছ অনেক দাম দিয়ে খুশি মনে কিনে নিয়ে গেছেন। তাঁরা পান তাই আপনারা পারেন না,তাই পান না। নানা কথায় বুঝিয়ে দিলেন যোগ্যতা ও সামর্থ্য নেই বলেই পন্ডিতি করি। মাছ দোকানি কেন আমার সমাজের এরকম ধারনা কিছু পাই বলেই শিক্ষকতা করি। একথা শুনে আমি কেন যে কোন সংবেদনশীল ব্যক্তিরই অপমান বোধ হবে। আমি শুনিনি ভাব নিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এলাম। আর মনে মনে বললাম, পারি বলেই তো, করি পন্ডিতি!এরকম অপ্রীতিকর অপমানজনক পররিস্থিতিতে আমাদের প্রতিনিয়তই ঘরে বাইরে মৌলিক চাহিদাগুলো পুরন করতেই নিগৃহীত হতে হয়। এরপর অনেকদিন ঐ মার্কেটে অনেকদিন মাছ কিনতে আর যাইনি। যাক সে কথা, এবার আসি আমার দেশের মেধাবী যোগ্যতা সম্পন্ন ক্ষমতাবানদের কাছে শিক্ষকদের মান মর্যাদা কেমন।এবার আসা যাক পে-স্কেল সম্পর্কে। গত ২১ডিসেম্বর ২০১৪ইং ড: ফরাস উদ্দীন বেতন কমিশন অষ্টম বেতন কাঠামো মাননীয় অর্থমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে বেতন কাঠামো নিয়ে নানা বিতর্ক। যা বিগত সাতটি কমিশনের বেতন কাঠামো নিয়ে এমনটা বিতর্ক হয়নি। হঠাৎ করেই কমিশন টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলসহ শিক্ষক কর্মচারিদের গ্রেড বৈষম্য সৃষ্টি করে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য ও মর্যাদা অবনমন হয়। প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য বিশাল আকার ধারন করে।প্রায় দুই বছর ধরে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকরা বেতন বৈষম্য ও পদ মর্যাদার জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়ে আসছেন। শান্তিপূর্ণভাবে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ স্মারকলিপি কোন কিছুই করতে বাকি রাখেননি সহকারি শিক্ষকরা। তাঁদের দাবি প্রধান শিক্ষকদের পরের ধাপে বেতন পূন: নির্ধারন, শতভাগ পদ্দোন্নতি উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকদের বেতন প্রধান শিক্ষকদের পরের ধাপেই ছিল। ২০০৫ সালের পর থেকে সহকারিদের সাথে বেতন বৈষম্যের শুরু। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ৯মার্চ ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দান করেন। তা প্রধান শিক্ষকদের প্রাপ্য। তাই বলে সহকারি শিক্ষকদের একধাপ বেতন বৃদ্ধি! এতে সহকারিদের সাথে তিন ধাপের ব্যবধান সৃষ্টি করে। যা কখনই কাম্য নয়। কেননা, সহকারি শিক্ষকরা ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকদের পরের ধাপেই বেতন পেতেন।কিন্তু কেন, কি কারনে এই বৈষম্যের সৃষ্টি করা হলো তার যৌক্তিক কোন কারন জানা নেই। এই বৈষম্যের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা কখনও কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের মাঝে অন্য কোন পদও নেই। বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলিয়াই মনে করা হয়। এই চাওয়া তাঁদের অতিরিক্ত চাওয়া বা অযৌক্তিক কিছু নয়। যা সহকারি শিক্ষক ১৯৭৩ সাল থেকে পেয়ে আসছে। গত ১৯অক্টোবর২০১৪ ইং তারিখে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় পরিদর্শন করে এই পে-স্কেলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনের আশ্বাস দেন। এমন কি পে- কমিশনকে শিক্ষকদের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের কথাও বলেন। সর্বশেষ সর্বস্তরের শিক্ষকদের মাঝে যখন অসন্তোষ চরমে তখন গত ১লা নভেম্বর বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটির সভা শেষে অর্থমন্ত্রীর টিভি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারে বলেন শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের সন্তোষজনক সমাধান দেওয়া হবে। প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের মাঝের এতটা ব্যবধান কাম্য নহে। যার সম্মানজনক সমাধান দিবে বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটি। এই দিন শিক্ষক সমিতির একটি অংশের শিক্ষক নেতাদের সাথেও অর্থমন্ত্রীর সহকারি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিয়ে কথা হয়। তিনি তাঁদের বৈষম্য নিরসনের আশ্বাসও দেন। আমি দেখেছি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষনায় শিক্ষকদের বিষয়ে অন্তরিকতার প্রতিচ্ছবি টিকরে বেরুতে।কিন্তু গত ১১ডিসেম্বর ২০১৫ইং কালেরকন্ঠের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা অর্থ ও আইনমন্ত্রনালয়ের সূত্রে পাওয়া। দুই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বেতন কাঠামোর মাধ্যমে নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে। চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে ক্যাডার কর্মকর্তাদের আগের মতো অষ্টম গ্রেডে রাখা হলেও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে নবমগ্রেডে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি পূরণ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) পদ সৃষ্টি করতে বলা হয়েছে। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চতুর্থ গ্রেডের ওপরে ওঠার দাবি সুরাহা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু কোথাও প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনের কথা উল্লেখ নেই, কোন মন্ত্রনালয়কে দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। মনে হয় বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটি প্রাথমিক শিক্ষকদের বিষয়টি সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। নাকি বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটিও কমিশনের মত প্রাথমিক শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি প্রয়োজন মনে করেননি অষ্টম বেতন কাঠামোতে সবচেয়ে বেশী শিক্ষকদের অপমানিত করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত অতি তুচ্ছই মনে হয়েছে। বিশেষ করেরে বলতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের কথা। প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকদের বিষয়টি প্রধান মন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বৈষম্য নিরসনের নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন উপেক্ষিত কোন প্রকার ব্যাখ্যা ব্যতীত।ভাবখানা যেন এমন যে, তাঁরা কোনদিন কোন প্রাথমিক শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন নাই। পৃথিবীর কোথাও কি শিক্ষকরা এভাবে বেতন বৈষম্য নিরসনে আন্দোলন করেন,তাতো কোনদিন শুনি নাই। তা তো বিষয়টি নজরে আসার সাথে সাথে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা!কোন দেশের শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি যদি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় না আসে, শিক্ষকদের দাবি আদায়ে যদি রাস্তায় থাকতে হয়, তাহলে কিভাবে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব আমরা মানব সম্পদ উন্নয়নের কথা বলি, স্বপ্ন দেখি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। এই দুটার জন্যই প্রয়োজন মান সম্মত শিক্ষা। বিশেষ করে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে উচ্চ শিক্ষাসহ সর্বস্তর মান সম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষক দিতে পারব। পারব দেশের সর্বস্তরে মেধাবীদের পৌছে দিতে। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে পৌঁছতে দেশের ছাব্বিশ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করন করেন এবং গতকাল মাননীয় প্রধান মন্ত্রীবেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকেও জাতীয়করনের কথা বলেছেন এবং বিদ্যালয়ের হিসাব ও অবস্থান জানাতে বলেছেন। সরকারের শিক্ষা নিয়ে আন্তরিকতার অভাব আছে বলে আমি মনে করি না।অথচ প্রধান মন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বিবেচনায় নেইনি কমিশন ও বৈষম্য নিরসন কমিটি। যুগ উপযোগি মানব সম্পদ তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাথমিক শিক্ষকদেরই চরম অবহেলার চোখে মূল্যায়ণ করছে কমিশন। যা বর্তমান শিক্ষা বান্ধব সরকারের সাথে যায় না। যুগ যুগ ধরে প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চিত করে কি আমরা মাধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি! আমরা কি শিক্ষকদের আজীবন সৈয়দ মুজতবা আলীর পন্ডিত মশাইদের মর্যাদায় মর্যাদাবান করে রাখবো?এটা কি আমাদের মান সম্মত শিক্ষার অন্তরায় হিসেবে ভূমিকা রাখবে না। আমরা যদি বর্তমান বেতন কাঠামোর দিকে তাকাই তাঁদের অবস্থান কোথায় খোঁজে পাই! যা কিনা তলনিতে! একটি দেশের জাতি গড়ারকারিগরদের অবস্থান ঐ চৌদ্দ নং গ্রেডেই, ভাবা যায়! এটাই কি সম্মানজনক সমাধান? শিক্ষকদের এই অবস্থান জাতির জন্য লজ্জার নয় কি!

লেখক : শিক্ষক ও কলামিষ্ট।
স্বপন তালুকদার
০১৭৩৫৩২৯৫৮৪
১৪/১২/২০১৫ইং