যৌন উত্তেজক ওষুধ ‘পাওয়ারে’ কাবু যুবসমাজ

59564ডেস্ক রিপোর্টঃ যৌন উত্তেজক ওষুধে ঝুঁকছে যুবসমাজ। ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যেই। যৌন উত্তেজক এসব ওষুধের সাংকেতিক নাম দিয়েছে ‘পাওয়ার’। আর এ পাওয়ারেই কাবু হচ্ছে যুব সমাজ।
সরকার বিদেশ থেকে যৌন উত্তেজক কিছু ওষুধ আমদানি নিষিদ্ধ করলেও তা দেদার প্রবেশ করছে দেশে। এছাড়া দেশীয় কিছু কোম্পানিও তা উৎপাদন করছে। ‘পাওয়ার হর্স,’ ‘পাওয়ার প্লাস,’ ‘ফিলিংস,’ ‘জিনসিন’সহ বিভিন্ন ব্রান্ডের যৌন উত্তেজক সিরাপ বিক্রি করছে। এ ছাড়া অধিকাংশ ওষুধের দোকানে ‘ফুলফিল,’ ‘ক্যাপসুল পাওয়ার,’ ‘ইনসারা,’ ‘এডেগ্রা,’ ‘ডিসোরেক্স’ ইত্যাদি ট্যাবলেটের ব্যবসাও জমজমাট। তবে এসব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা কেউ মানছেন না। স্বাস্থ্য ও মাদক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ওষুধ এক ধরনের মাদক। আসক্তি বাড়ানো ওষুধগুলো শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

বিভিন্ন ফার্মেসির বিক্রেতারা জানান, ভারতের ইন্টাগ্রা ৫০ বা ১০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ১০০ টাকায়। আমেরিকার ভায়াগ্রা প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। ভারতের সেনেগ্রা ও কামাগ্রা প্রতি ট্যাবলেট ৫০ থেকে ৭০ টাকা। সেনেগ্রা, টেনেগ্রা, ফরজেস্ট, ক্যাবেটরা, টার্গেট ও ইডেগ্রা বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা। বেশির ভাগ ওষুধের গায়ে মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ লেখা থাকে না। আমেরিকার টাইটানিক এক বোতলের দাম চার হাজার টাকা। খুচরা ট্যাবলেট ৪০০ টাকা। টাইটানিকে ইয়াবার মতো উত্তেজনার পাশাপাশি নেশা হয়। তাই ইয়াবার ক্রেতারা কেউ কেউ টাইটানিক সেবন করছেন। কম দামে পাওয়া যাচ্ছে চীনের জিয়ংবার। একটি ট্যাবলেটের দাম ৭০ টাকা। কেজি পাস (ইউএসএ) কৌটা ৫০০ টাকা। জে হরমালিন ৭৫০ টাকা। কস্তুরি গোল্ড ৫২০ টাকা। পাকিস্তানি ফরজেস্ট-২০-এর মূল্য ৩৫০ টাকা। জিনসিন ৯০০ টাকার দরে বিক্রি হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা ও সারা দেশের খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা রাজধানীর মিটফোর্ড ও চানখাঁরপুল থেকে দেশি-বিদেশি যৌন উত্তেজক ওষুধ কিনে এলাকায় চড়া দামে বিক্রি করছেন। খুচরা বিক্রেতারা এসব ওষুধকে পাওয়ার বলে ডাকেন। অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে তারা পাওয়ারও নিয়ে নেন প্রয়োজন মতো। শাহবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডি, মিরপুর রোড, শেরে বাংলানগরসহ সবখানেই পাওয়ার খুচরা বিক্রি হচ্ছে। মিটফোর্ডের কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতা জানান, সরদার মার্কেটকে বলা হয় ‘ইন্ডিয়ান’ মার্কেট। এ মার্কেটের নিচতলার দোকানগুলোতেই পাওয়ার ওষুধ বেশি বিকিকিনি হয়। এছাড়া খান মেডিসিন মার্কেট, হাবিব মার্কেটসহ সব মার্কেটে এখন উত্তেজক ওষুধ বিক্রি হয়। রাজধানীর অভিজাত এলাকার ওষুধের দোকানেই বিক্রি বেশি। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর যুবক-যুবতীরা এসব ওষুধ খাচ্ছে। কিছু উত্তেজক ওষুধ খেলে চেহারায় লাবণ্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এ কারণে শখ করে খায় অনেকে।

এছাড়া আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, ইন্টাগ্রাসহ বিভিন্ন ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়েছে যুবসমাজ। একশ্রেণীর অপচিকিৎসায় এ ধরনের ওষুধের মাধ্যমে যৌন দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা চালানো হয়। ওই সব কথিত চিকিৎসক এ ধরনের ওষুধ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটেও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয় বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাটবাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন চটকদার নামের যৌন উত্তেজক সিরাপ ও ট্যাবলেট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধ দেশে আসছে। বিমানবন্দরে প্রায়ই ধরা পড়ে এ ধরনের বড় চালান।

অভিযোগ আছে, পাচারকারীদের সঙ্গে সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। তাই মূল হোতারা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায়ই আমদানি-নিষিদ্ধ এসব ওষুধ আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ২০০৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর কাস্টমস প্রায় সোয়া কোটি টাকার আমদানি-নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধ আটক করে। তবে রহস্যজনকভাবে ওষুধ পাচারকারীচক্রের কাউকেই আটক করতে পারেনি। চারটি লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে পাকিস্তানে তৈরি ২৩ ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন জব্দ করা হয়।

সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সকালে কার্গো ভিলেজে পড়ে থাকা পাঁচটি বড় কার্টন কাস্টমস কর্মকর্তারা গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতিতে খুলে দেখেন কয়েক হাজার পিস উত্তেজক ওষুধ। এ চালান আনা হয় ভুয়া একটি গার্মেন্টের নামে। এর সঙ্গে জড়িত সিদ্দিক নামে এক পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা গেছে, কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ এবং উত্তরাঞ্চলের ভারতের সীমান্ত হয়ে ইয়াবার সঙ্গে উত্তেজক ওষুধের চালান আসছে দেশে।

উত্তেজক ওষুধে আসক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে কৌতূহলেই খাওয়া শুরু করেন তারা। ভালো লাগা থেকে এখন আসক্তি ও নেশা। কেউ কেউ বিশেষ শারীরিক ক্ষমতা বাড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করেন। পরে ওষুধ না খেলে তারা স্বস্তি পান না।

তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, উপযুক্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো উত্তেজক ওষুধ সেবন করা ঠিক নয়। এতে শরীরের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী-পুরুষদের মধ্যে ২ থেকে ৫ শতাংশের দুর্বলতা থাকতে পারে। ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশের মানসিক সমস্যা। সে জন্য বিভ্রান্ত হয়ে উত্তেজক ওষুধ খায় অনেকে। এসব ওষুধ হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়। এতে লিভার ও নার্ভ ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

তবে মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ীদের দাবি, ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অভিযানের অভাবেই এসব ওষুধ বিক্রি হয়। ডাক্তাররা এসব ওষুধ নিতে ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন, তাই অনেকে দোকানে নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধ রাখেন। এমন বক্তব্য আরও অনেক ব্যবসায়ীর। বিদেশি আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধের আদলে এখন দেশি কোম্পানি উত্তেজক ওষুধ বাজারে ছাড়ছে। ওষুধ প্রশাসন এসব ওষুধের অনুমোদনও দিয়েছে। ওষুধ প্রশাসন কর্মকর্তারা বলেন, উত্তেজক হিসেবে যেসব ওষুধ বাজারে বিক্রি হয় তা ভেজাল এবং অনুমোদনহীন। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেরা তৈরি করে বিদেশি সিল লাগিয়ে দিচ্ছেন। দেশি কোনো কোম্পানিকেও এ জাতীয় ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়নি। ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ক্ষতিকর সব উপাদান আছে।

র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, যৌন উত্তেজক ওষুধ আটক করছে র‌্যাব। গত এক বছরে ৩০ থেকে ৩২ কোটি টাকার নিষিদ্ধ ওষুধ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে যৌন উত্তেজক ওষুধের পরিমাণ এক থেকে দেড় কোটি টাকার। র‌্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, কোথায়, কিভাবে এসব ওষুধ বিক্রি হয় তা খতিয়ে দেখার জন্য আলাদা প্রশাসন কাজ করছে। তবে ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। এসব ওষুধ ভেজাল বা অনুমোদনহীন বলেই এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যায়।

এ বিষয়ে র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, বাজারে নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধের শতকরা ৮০ ভাগই ভারত থেকে আসে। যৌন উত্তেজক সেনেগ্রা ওষুধই বেশি বিক্রি হয় বলে তাদের অভিযানে উঠে এসেছে। এছাড়া দেশি হরবাল ওষুধ জিংসন যৌন উত্তেজক হিসেবে সেবন করছে কেউ কেউ। যদিও এটি কমমাত্রায় অনুমোদন নিয়ে উচ্চমাত্রার শক্তিবর্ধন করে বিক্রি করছে কোম্পানিটি। তিনি আরও জানান, র‌্যাব সাড়ে তিন মাস আগে মিটফোর্ড রোডে অভিযান চালিয়ে যৌন উত্তেজক ওষুধ রাখার দায়ে ৪টি দোকানকে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এছাড়া শাহবাগ আজিজ সুপাার মার্কেটের একটি দোকানকেও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক এক নেতা বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী প্রকাশ্যেই উত্তেজক ওষুধ বিক্রি করেন। কেউ কেউ অকারণে ব্যবহার করছে এই ওষুধ। আগে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে এলেও এখন ভারত থেকেই বেশি আসছে যৌন উত্তেজক ওষুধ। দেশেও তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো নীতিমালা নেই। সরকার ও দোকানদারদের জবাবদিহি থাকতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতার সচেতন হওয়া উচিত। ঢালাওভাবে বিক্রি করা উচিত নয়। এই ওষুধ ব্যবহারে কঠিন হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। যৌন উত্তেজক ওষুধের জন্য চিকিৎসকরা লাল মেমোতে প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন। যার জন্য প্রযোজ্য সেই ব্যক্তি এই ওষুধ ব্যবহার করতে পারে। ঢালাওভাবে সবাই নয়। প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই মিটফোর্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ওষুধ বিক্রি হয়। এসব বিষয়ে প্রশাসন ভূমিকা না রাখলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, কোনো ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। ইদানীং দেশে যুবসমাজের মধ্যে যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবন করার মাত্রা বেড়ে গেছে। এতে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হতে পারে জটিল রোগও। তাই এ ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের চৌধুরী বলেন, বিদেশি এ ধরনের কোনো ওষুধ অনুমোদন দেয় না ওষুধ প্রশাসন। আমাদের দেশে এ ধরনের কিছু ওষুধ বিক্রির অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও বিদেশি ওষুধ সেবন করছেন কেউ কেউ। যা ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি আরও বলেন, ওষুধ প্রশাসন র‌্যাবের সঙ্গে মিলে এ ধরনের নিষিদ্ধ ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। – মানবজমিন