সিলেটি নাগরি লিপি : ISO স্বীকৃতি থাকলেও জাতীয় স্বীকৃতি নেই
এইচ.এম আলমগীরঃ যুগে যুগে একটি দেশ বা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুপ্রেরনা ঐ জাতিকে নিয়ে গেছে সাফল্যের চরম শিখরে । আর একটি সফল জাতির কোন মূল্যবান ইতিহাস বা ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঐ জাতির জন্য চরম লজ্জা ও অপমানজনক ব্যাপার।ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী এক গৌরবান্বিত জাতি হিসেবে আমরা কখনো হারিয়ে যেতে দিতে পারিনা আমাদের সমৃদ্ধ কোন ঐতিহ্যকে।
কিন্তু এটি চরম সত্য যে সিলেট তথা পুরো বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্যতম সম্পদ নাগরি বর্ণ বা নাগরি লিপি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে । ডঃ সুনীত কুমার চট্রোপাধ্যায় ও প্রমুখের মতে বিখ্যাত ধর্মীয় পরিব্রাজক হযরত শাহজালাল (রঃ) ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন সিলেট আগমন করেন তখন তিনি এই লিপি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন । পর্যাক্রমে এটির বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ , নেত্রকোণা কিশোরগঞ্জ , ভারতের আসাম , কাছড়া ও করিমগঞ্জে ।
৫টি স্বরবর্ণ ও ২৭ টি ব্যাঞ্জনবর্ণে চমৎকার সাজানো এই লিপিতে লেখা হয়েছিল বহু চিটি , হিসাবপত্র , ও সরকারী দলিল দস্তাবেজ । সাহিত্যের ক্ষেত্রে রেখেছিল বিশেষ অবদান , এই লিপিতে লেখা হয়েছিল শতাধিক বই । তৎকালিন প্রসিদ্ধ হালাতুন্নবী , মহব্বত নামা ,নূর নছিহত তালিব হুছন সহ অসংখ্য গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবিতা ।
পৃথিবীর ৮ হাজার ভাষার মধ্যে ৩ হাজার ভাষার বর্ণমালার উল্লেখ রয়েছে , তন্মধ্য রয়েছে বাংলাদেশের দুটি ভাষা যথা বাংলা বর্ণমালা ও সিলেটি ভাষার নাগরি বর্নমালা । ফ্রান্সের ভাষা যাদুঘরের সংরক্ষিত বর্ণমালায় উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের এই দুটি বর্ণের । এই বর্ণ আয়ত্ত করা এতই সহজ যে তৎকালিন
একটি প্রবাদ ছিল এই রকমঃ
“কাজির ঘরর বান্দিয়েও যেমন আড়াই হরফ জানে অলান নাগরিও হিকা যায় মাত্র আড়াই দিনে” ।
অত্যান্ত আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এতকাল এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সম্পদ কেবলই ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্টে নিমজ্জিত ছিল । তবে আশার বিষয় যে এটিকে ইতিহাসের পাতা থেকে বের করে আনতে কাজ করছে এক ঝাক তরুন ।
তরুনদের হাতে আলোর মর্শাল থাকলে অন্ধকার ঘোচে যাবে এটাই নিশ্চিত , আর নাগরি বাঁচাও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্ধকারের বদ্ধ খাঁচা থেকে বের করে “ইতিহাসের পাতায় নয়, নাগরি থাকবে আমাদের অন্তরে ঘরেঘরে” এই স্লোগানকে সামনে রেখে কাজ করছে এই তরুনেরা ।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে Unicode Consortium এর সহায়তায় সিলেটের নাগরি লিপি ইউনিকোডের (ISO 15924,Sylo-316) মাধ্যমে ISO স্বীকৃতি লাভ করেছে , কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের বিষয় এর কোন জাতীয় স্বীকৃতি নেই । নাগরির ইতিহাস তুলে ধরে এর জাতীয় স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ৭ মে ২০১৫ সালে সিলেটের কৃতি সন্তান ইতিহাসবিদ , ইতিহাসারত্ন ডঃমুমিনুল হক গঠন করেন ‘নাগরি বর্ণে সিলটি ভাষা স্বীকৃতি পরিষদ’ আর ইতিহাসবিদ হিসেবে রচনা করেন ৬ টি মূল্যবান গ্রন্থ যথাঃ বাংলার ইতিবৃত্ত , সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত , মৌলবী বাজারের ইতিহাস ,রাজনগরের ইতিবৃত্ত , The History Of Bangladesh এবং শুধু মাত্র নাগরীর অতিথ ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন সিলেটি ভাষার নাগরি বাঁচাও আন্দোলন শিরোনামের একটি গ্রন্থ । তাঁর পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে সিলেটের বিভিন্ন জেলা , উপজেলা , ইউনিয়ন কলেজে গঠন করা হয়েছে উক্ত পরিষদের কমিটি । শুধু সিলেট নয় পরিষদের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , লিডিং ইউনিভার্সিটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি , কাজ চলছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের
কমিটি গঠনের । প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রদান করা হয়েছে স্মারক লিপি ।
কমিটির প্রতিটি সদস্যই ভালবাসার টানে অক্লান্ত শ্রম,অর্থ ও ভালবাসা দিয়ে নাগরি পৌছে দিয়েছেন শহর পাড়া ও গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে । ড. মুমিনুল হকের অর্থায়নে ইতিমধ্যে বের হয়েছে নাগরি বর্ণের ক্যালেন্ডার
,ম্যাগাজিন ও ত্রৈমাসিক পত্রিকা সিলেটি খবর।আর তাঁকে সার্বিক সহযোগীতা করছেন দেশ-বিদেশের সহস্রাধিক তরুন । উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন ইফতেখার আহমদ , মিসবাহ উদ্দিন , শ্যামল চন্দ্র ,আনোয়ার হোসেন , তাঁরা জৈন্তাপুর , গোয়াইনঘাট , কানাইঘাট উপজেলা , এম.সি কলেজ , সরকারি কলেজ , লিডিং ইউনিভর্সিটি শাহজালাল কলেজ সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ,কলেজ ও ইউনিয়নে কমিঠি গঠন করে স্ব-অর্থায়নে লিফলেট বিতরণ ও পরিষদের উপকরণ সকলের হাতে হাতে পোছে দিচ্ছেন , বিপ্লব কান্তি আবিষ্কার করেছেন নাগরি ফন্ট ।আমি এই সংগঠনের একজন কর্মী হিসেব নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি ।
সংগঠনের দৃড় বিশ্বাস এই তরুনদের হাতকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে আসবে দেশের সচেতন সমাজ , সকল স্তরের দেশপ্রেমী নাগরিক । সংগঠনের সকলের একটাই প্রত্যাশা এই আলোর মর্শাল জ্বলে উঠবেই , একদিন স্বীকৃতি পাবে প্রাণের সম্পদ সিলেটি নাগরি । যা শুধু সিলেট নয় বস্তুত এই দেশরই এক অমূল্য সম্পদ।