যুদ্ধবিধ্বস্তরা কখনো যুদ্ধাপরাধী নয় : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

Adv-Sirajiএ্যাড, সিরাজী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক: আন্তর্জাতিক আইনে তথা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের যতগুলো বিচার সম্পন্ন হয়েছে, সবগুলোতে শুধু আক্রমণকারী বাহিনী বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকেই যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যেমন, নুয়েমবার্গ ট্রায়াল (১৯৫০), টোকিও ট্রায়াল (১৯৪৫), আইকম্যানের মামলা, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (১৯৯২) এবং রুয়ান্ডা ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (১৯৯৪) উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত বিচারে কখনও যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় নাগরিকদেরকে অভিযুক্ত করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধী বলতে তাতে স্পষ্ট উল্লেখ হয়েছে, ÒIn the case of an international armed conflict, any of the following acts committed against persons or property protected under the provisions of the relevant Geneva Convention: A) Wilful killing. B) Torture or Inhuman treatment, including biological experiments…” (তথ্যসুত্রঃ https://www.icrc.org/customary-ihl/eng/docs/v1_rul_rule156)
এখানে armed conflict বলতে স্পষ্টভাবে সেনা সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এদেশে সেনা আক্রমণ হয়েছিল কিন্তু সেনা প্রতিরোধ ছিলনা। কারণ, সেনা পরিচালনাকারী সকল নেতৃবৃন্দ তথা বঙ্গবন্ধু সরকারের কেউ তখন দেশে ছিলেন না। তারা ২৫ শে মার্চ থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন। সে ভয়াবহ কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনী এদেশের সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙ্গালীর ওপর নিষ্ঠুর হামলা চালিয়েছিল। তারা মাত্র ২৬৬ দিনে ত্রিশ লাখ বাঙ্গালীকে শহীদ করেছে এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম কেড়েছে। তখন সারাদেশ এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ জনতা দিগি¦দিক শুন্য হয়ে বাঁচার পথ খুঁজছিল। যে যেভাবে পেরেছে, আত্মরক্ষার পথ বেছে নিয়েছে। বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একান্ত সহকর্মী ড কামাল হোসেনসহ পাক জান্তার হাতে ধরা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় পাঁচ লাখ সাধারণ বাঙ্গালী যুদ্ধকালীন পুরো সময় পাকিস্তানে বন্দি ও অবরূদ্ধ দিন কাটান। তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য সকল নেতৃবৃন্দ ছদ্মবেশে ভারতে পাড়ি জমান। তারাও পুরো সময় ভারতে কাটান। হাজার হাজার ইপিআর সেনা শহীদ হন আর বহু সেনা বন্দি দিন কাটান। লাখ লাখ সাধারণ বাঙ্গালী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে চরম মানবেতর দিন কাটান। এরপরও দেশে থাকেন অবশিষ্ট কোটি কোটি অসহায় সাধারণ বাঙ্গালী। তারা পাক হানাদার বাহিনীর থাবার মুখে ত্রস্ত দিন কাটান। অনেকে প্রাণভয়ে পাকবাহিনীর সাথে নানা জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তারা একান্ত বাধ্য হয়ে শুধু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। এ অসহায়ত্বের দরুন তারা যতবড় অপরাধই করুক, তা কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারেনা। তাই ১৯৭১ সালে এদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় বাঙ্গালীরা কখনো যুদ্ধাপরাধী নয়। অত্যাচারী পাক সেনারাই আসল যুদ্ধাপরাধী।
আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার সংস্থার অভিন্ন রিপোর্ট হলো, যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় জনগণ কখনো যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা কঠিন পরিস্থিতির শিকার। তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত ও সুবিধা বঞ্চিত। তারা আক্রমণকারীর হাত থেকে প্রাণ রক্ষায় ব্যস্ত। আত্মরক্ষার স্বার্থে তারা যত ঘৃণিত অপরাধই করুক না কেন, তা যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে না। বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এ সকল যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নিপীড়ত মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়, তখন আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার সংস্থা তৎপর হন। তারা সাধারণ জনতাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগীতার ফলেই এদেশের কোটি কোটি সাধারণ বাঙ্গালী আক্রমণকারী পাকি সেনাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। এভাবে অসহায় সাধারণ জনতা বিভিন্ন নামে-বেনামে নানা বাহিনী গড়ে তোলেন। তারা আত্মরক্ষার স্বার্থে পুরো যুদ্ধকালিন সময়ে একইসাথে পাকবাহিনী ও ভারতীয় সহযোগী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে সার্বিক সহযোগীতা করেন এবং স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন। তারা শান্তিকমিটি গঠন করেন। যার সদস্যরা অধিকাংশই ছিলেন, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী। আবার রাজাকার বহিনী গঠন করেন। তারা এদেশেরই মুল্যবান সম্পদ পাহারা দিয়ে আবার পাকসেনাদের থেকে বড় অঙ্কের বেতন আদায় করেন। এছাড়া ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এ শহীদ শত শত বুদ্ধিজীবীগণও পাক সেনাদের বেতনভোগী ছিলেন এবং আত্মরক্ষার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তারাও স্বাধীনতার জন্য অনেক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ সকল সাধারণ জনতা ও বুদ্ধিজীবীগণ কখনো যুদ্ধাপরাধী নন।
এ প্রসঙ্গে অনিবার্য সত্য হচ্ছে, ১৯৭১ এ স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র সাধারণ জনতা, তাদের ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা নারী সবাই এক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। এ মহান আত্মত্যাগীদেরকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা অনৈতিক। কিন্তু বাংলাদেশে তা একটি open secret।

এদেশে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এতে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ সম্পুর্ণ বৃথা প্রমাণ হয়েছে এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের বিসর্জন মূল্যহীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পুর্ণ বিকৃত হয়েছে। তাই আজ যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় বাঙ্গালীকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে অন্যায়ভাবে বিচার পরিচালনা করা হচ্ছে। স্বীকৃত পাকি যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে অসহায় বাঙ্গালীদের বিরূদ্ধে পরিচালিত এ বিচার সম্পুর্ণ অবৈধ। এটি বিচারের নামে প্রহসন। এতে সর্বস্বীকৃত পাকি যুদ্ধাপরাধী পেতাত্মাদের বিজয় হয়েছে।
অতএব, ১৯৭১ এ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙ্গালীদেরকে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা বেআইনি। বর্তমানে পাকি যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে নিরপরাধ বাঙ্গালীদেরকে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে বিচারের মাধ্যমে পৃথিবীতে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট করা হচ্ছে। দেশে বিভাজন সৃষ্টির গভীর ষঢ়যন্ত্র হচ্ছে। বহিঃশত্রুর আগ্রাসী আক্রমণকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। অতি সত্ত্বর তা বন্ধ করা উচিত। এদেশের ষোল কোটি নাগরিককেই ত্রিশ লাখ শহীদ ও স্বাধীনতা প্রত্যাশী সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর গর্বিত সন্তান হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষকে অযথা মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বিভাজন করা উচিত নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো গর্বিত নাগরিককে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে পুরো জাতিকে হেয় করার হীন চক্রান্ত প্রতিহত করা উচিত।

[email protected].