গোলাপগঞ্জ পৌর মেয়র পাপলুর জালিয়াতি ফাঁস
নোমান মাহফুজ: নাগরিক সুবিধার মান দ্বিতীয় শ্রেণীর। যদিও পৌরসভাটিকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। এতে প্রথম শ্রেণির কাঠামোতেই হাটবাজার ইজারা, আয়কর নির্ধারণ হচ্ছে। তবে, নাগরিকদের জীবনমানের কোনো উন্নতিই চোখে পড়ছে না। উল্টো পৌরসভার ৫ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। নেপথ্যে পৌর মেয়র জাকারিয়া আহমদ পাপলুর জড়িত থাকার অভিযোগ
রয়েছে। কেননা তাকে বারবার তাগাদা দেয়ার পরও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ওপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২ জুন স্থানীয় সরকারের সিলেট বিভাগের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান গোলাপগঞ্জ পৌরসভা পরিদর্শন প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সেখানে তিনি মেয়র পাপলু’র অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্তের সুপারিশ করেছেন। একই সঙ্গে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও মেয়র পাপলু’র দায়িত্ব পালনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
পাপলু’র সঙ্গে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী যোগেশ চ্যাটার্জীর গোপন যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবেদনে তাকেও অন্যত্র বদলির জন্য বলা হয়েছে। পাপলু’র বিরুদ্ধে ২০১০-১৪ পর্যন্ত মোট ৩২টি পরিদর্শন আপত্তি আছে। এসব আপত্তিতে তার বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তিনি একটিরও জবাব দিতে পারেননি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার আয়-ব্যয়ের হিসাব পদ্ধতিগতভাবে রাখা হচ্ছে না। বার্ষিক কোনো হিসাব বিবরণী প্রস্তুত করা হয় না। হিসাব বিবরণী প্রদর্শনের নিয়ম থাকলেও তা গোপন রাখা হচ্ছগে। দুর্নীতি করার জন্যই এ আর্থিক অব্যবস্থাপনা।
মেয়র পাপলু নাগরিকদের কথা বিবেচনা না করেই হোল্ডিং ট্যাক্স চারগুণ বাড়িয়েছেন। এতে আগে ট্যাক্স আদায়ের রেকর্ড ভালো থাকলেও বর্তমানে হতাশাজনক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ট্যাক্স দাবির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ওই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। বকেয়া ছিল ৬৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে ট্যাক্স দাবি করা হয় ৪ কোটি ২৮ হাজার টাকা। এতে আদায় হয়েছে মাত্র ২০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। বকেয়া থেকে যায় ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। তাই ট্যাক্স দাবি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
নাগরিকদের অভিযোগ, পাপলু তার ছোটভাই ব্যাংক কর্মকর্তা হোসেন আহমদ সাপলুকে দিয়ে ধনী পরিবারের ব্যাংক স্টেটমেন্ট জেনে বেশি বেশি ট্যাক্স দাবি করছেন। পাপলু হাট ইজারার বেলায়ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। সালেহ আহমদ নামে তার এক মামা ইজারার টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেও তাকেই বার বার হাটটি ইজারা দিচ্ছেন। বর্তমানে ওই ব্যক্তিকে ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকায় হাট ইজারা দেওয়া হয়। অথচ বিগত বছরে একই হাট একই ব্যক্তির কাছে ১৯ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছিল। হাট ইজারায় কোনো চুক্তিপত্র নেই।
চলতি সনের ইজারা এখনো পরিশোধ হয়নি। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতির অভিযোগে পাপলু কারাগারে থাকলে একই হাট ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় ইজারা গিয়েছিল। মূলত, পাপলু হাট নিয়ে গোপনে মৌখিক লেনদেনে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া হাটের ইজারার টাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা খাতের টাকা কর্তন হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, মেয়র পাপলু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সরকারি নীতি মেনে সভা করছেন না এবং পরিষদের সভার সংখ্যা কম। তাছাড়া, মেয়র এসব সভার রেজুলেশনে স্বারও ঠিকমতো করেন না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এডিপির টাকা ব্যাংকে এফডিয়ারের নামে স্থানান্তও করে মেয়র পাপলু ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক ফায়দা হাসিল করছেন। চলতি বছরের ১৮ মার্চ এডিপি খাতে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। পাপলু এডিপির ৩০ লাখ টাকা ব্যাংক কর্মকর্তা ভাই সাপলুর কর্মস্থল ন্যাশনাল ব্যাংকে এফডিয়ার করে রেখেছেন। স্থানীয়রা জানান, ভাই সাপলুকে টাকার চুক্তিতেই ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকিয়েছেন মেয়র পাপলু।
এছাড়াও ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পৌরসভার নানা অনিয়ম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী যোগেশ চ্যাটার্জীকে দিয়েই সব দায়িত্ব পালন করাচ্ছেন পাপলু। দীর্ঘদিন থেকে পৌর সচিব, সহকারী প্রকৌশলী ও হিসাবরক পদটি শূন্য রয়েছে। পৌরসভায় ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রায় ২০০ জন। কিন্তু বাস্তবে কাজ করেন মাত্র ৫-৭ জন। ২০১২-১৩ সালে পৌরসভা ভবনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ প্রকল্পে (এডিপি) নির্মাণ ঠিকাদার না হওয়া সত্ত্বেও মেসার্স আহাদ এন্টারপ্রাইজকে ৭৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে। অথচ আহাদ একজন প্রকিউরমেন্ট প্রভাইডার। এই আহাদ পাপলুর ব্যবসায়ীক অংশীদার বলে জানা গেছে।
পাপলুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : ছিলেন জননন্দিত মেয়র। দুর্নীতি মামলায় জেল খেটেছেন। বর্তমানে নাগরিকদের সাথে মামলায় জড়িয়ে জনরোষে পড়েছেন মেয়র পাপলু। তাই হয়তো আখের গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জড়িয়ে পড়েছেন নানা অনিয়মে। অনিয়ম লুটপাটের টাকায় এখন আলিশান বাড়ি হচ্ছে, নামে-বেনামে জমি কেনা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গোলাপগঞ্জ চৌমুহনী জামেয়া মাদ্রাসার বিপরীতের একটি প্লটে জমি কিনেছেন পাপলু। জমির মূল্য ১ কোটি ৩৫ লাখ। ৬৫ লাখ টাকা জমির মালিককে পরিশোধ করা হয়েছে। বকেয়া আরও ৭০ লাখ টাকা। এই জমির দলিল নং ৪২৯৫/১১। ঢাকা দক্ষিণ সাব রেজিস্ট্রি অফিস। বায়নানামা দলিলের স্ট্যাম্পে (নং৪২৭) পাপলু নিজের নাম সামান্য পাল্টেছেন। জাকারিয়া আহমদ পাপলু’র স্থানে জাকারিয়া ‘হোসেন’ পাপলু লিখেছেন। পরে এই জমিটিই তিনি মৌলভীবাজারের নালীউড়ি গ্রামের জাকির আহমদের নামে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, পাপলুর এত টাকার উৎস কী? নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নাগরিক বলেন, ‘পৌরসভাটি দেখানো হচ্ছে এ’ গ্রেডের। কিন্তু আদৌ এ গ্রেডের কিচ্ছু নেই এখানে। পৌরশহরে নিম্নমানের বিদ্যুতের খুঁটিতে বসানো ৩৫ ওয়াটের বাল্ব। আর বিল তোলা হচ্ছে ৮৫ টাকার। হোল্ডিং ট্যাক্স মুখ দেখে দেখে কমানো-বড়ানো হয়।’ জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের স্থানীয় সরকার পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পৌরসভাটিতে পরিদর্শন করে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। এখানে টাকার অসঙ্গতিও উল্লেখ আছে। কিন্তু এ বিষয়ে মেয়র কোনো জবাব দেননি। আমরা সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’ এ বিষয়ে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জাকারিয়া আহমদ পাপলু বলেন, ‘হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। তবে অডিট প্রতিবেদনে অহেতুক টাকার অসঙ্গতির অভিযোগ আনা হয়েছে।’