ফল বিপর্যয়েও দেশের ৮ শিক্ষা বোর্ডে সিলেট দ্বিতীয়

সিলেট বোর্ডে এইচএসসিতে পাসের হার ৭৪.৫৭

পাসের হার কমেছে ৪.৫৯% ও জিপিএ-৫ কমেছে ৭১৪

তিন কারণে সিলেটে ফল বিপর্যয়। পাসের হারে মেয়েরা, জিপিএতে ছেলেরা এগিয়ে। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ এসেছে বেশি। চার জেলার মধ্যে এগিয়ে সিলেট। সিলেট বোর্ডে ১৩ কলেজের শতভাগ সাফল্য।

HSC Sylhet 2015সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিরতির পর বিরতি কখনো হরতাল কখনো অবরোধ এরই মাঝে এগিয়ে চলে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ কারনে গতবারের চেয়ে এ বছর এইচএসসিতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ও জিপিএ ৫ এর সংখ্যা দুটিই কমেছে। তারপরও দেশের ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। হরতাল-নাশকতা-অবরোধের কারনে সারা দেশেই ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। এ থেকে বাদ যায়নি সিলেটও।
সিলেটে এবারের উচ্চ মাধ্যামিক (এইচএসসি) পরীক্ষার পাসের হার ৭৪.৫৭ শতাংশ। জিপিএ ৫ (এ প্লাস) এসেছে ১৩৫৬টি। বোর্ডে ছেলেদের পাসের হার ৭৩.৯৮ ও মেয়েদের পাসের হার ৭৫.০৭। গতবছর পাসের হার ছিলো ৭৯.১৬। জিপিএ ৫ পেয়েছিলো ২০৭০জন শিক্ষার্থী। গতকাল রোববার দুপুরে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ ফলাফল জানান সিলেট শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুল মান্নান খান। ফলাফলে সারা দেশের ৮টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট। গত বছরের তুলনায় সিলেট বোর্ডে এবার পাশের হার কমেছে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অন্যদিকে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭১৪ জন।
বোর্ডের অধীনে ২৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট ৫৭ হাজার ৭০২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪৩ হাজার ২৮জন। এদের মধ্যে ছেলে ১৯ হাজার ৭২১ ও মেয়ে শিক্ষার্থী ২৩ হাজার ৩০৭ জন।
জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ১ হাজার ৩৫৬ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছেলে ৭৯৮ ও মেয়ে ৫৫৮ জন। এবার শতভাগ পাস করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩টি। আর কোনো প্রতিষ্ঠান পাস করেনি এমন সংখ্যা শূণ্য। এদিকে, গত বছরের সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারী কলেজের সংখ্যা ছিল ২০৩ টি। এবার কলেজের সংখ্যা ২৩১ টি। কলেজের সংখ্যা বেড়েছে ২৮ টি।
তিন বিভাগের পাসের হার : বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার ৭হাজার ৮৩ জন পরিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করেছে ৬ হাজার ২৮৬ জন। পাশের হার ৮৮ দশমিক ৭৫শতাংশ। মানবিক বিভাগ থেকে এবার ৩৯ হাজার ৩৪৫ জন পরিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করেছে ২৭ হাজার ৭৯৩ জন। পাশের হার ৭০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এবার ১১হাজার ২৭৪ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে ৮হাজার ৯৪৯ জন। পাশের হার ৭৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ এসেছে বেশি : জিপিএ ১৩৫৬। বিজ্ঞান বিভাগে ৯৩৮ জন, মানবিক বিভাগ থেকে ১৫০ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ২৬৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের ৭৯৮ জন ছেলে এবং ৫৫৮ জন মেয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে।
গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার ও জিপিএ ৫ কম পাওয়া প্রসঙ্গে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুল মান্নান খান বলেন, আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রেজিষ্ট্রেশন ও পরীক্ষা নিয়ে থাকি। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেই। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। তারা ভালো না পড়ালে আমাদের এখানে কিছু করার নেই।
পাসের হারে মেয়েরা, জিপিএতে ছেলেরা এগিয়ে : সারাদেশের মতো সিলেট শিক্ষাবোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে, এবার সিলেট শিক্ষা বোডে পাসের দিক থেকে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে জিপিএ ৫ পাওয়ার দিক দিয়ে মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে ছেলেরা। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষাবোর্ড থেকে অংশ নেন ৫৭ হাজার ৭০২ জন শিক্ষার্থী। এরমমেধ্যে ছাত্র ছিল ২৬ হাজার ৬৫৭ জন এবং ছাত্রী ছিল ৩১ হাজার ৪৫ জন। সিলেটে এবার পরীক্ষার্থীর সখ্যায়ও ছাত্রীরা বেশি।
ছাত্রদের মধ্যে পাস করেছে ১৯ হাজার ৭২১ জন। ছাত্রদের পাসের হার ৭৩.৯৮। অন্যদিকে ছাত্রীদের মধ্যে পাস করেছে ২৩ হাজার ৩০৭ জন। তাদের পাসের হার ৭৫.০৭। অর্থাৎ, ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাসের হার ১.০৯ বেশি। এদিকে পাসের হারের দিক দিয়ে মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও জিপিএ ৫ এর দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে ছেলেরা।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এবার মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ হাজার ৩৫৬ জন। এরমধ্যে ৭৯৮ জন ছেলে এবং ৫৫৮ জন মেয়ে।এছাড়া মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ গ্রেড পেয়েছে ৬ হাজার ৮৯৮ জন, এ মাইনাস গ্রেড ৭ হাজার ৬৭৩ জন, বি গ্রেড ৯ হাজার ৯২২ জন, সি গ্রেড ১৫ হাজার ২৫১ জন এবং ডি গ্রেড পেয়েছে ১ হাজার ৮২৮ শিক্ষার্থী। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে পাসের হার ও জিপিও ৫ কমলেও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হারে তৃতীয়বারের মতো দেশ সেরা ফলাফল অর্জন করেছিল সিলেট শিক্ষা বোর্ডের। এর আগে ২০১০ ও ২০১২ সালেও পাসের হারে সিলেট শিক্ষাবোর্ড দেশ সেরা ফলাফল করেছিল। সিলেট শিক্ষাবোর্ডে ২০১৩ সালে পাসের হার ছিলো ৭৯ দশমিক ১৩ ভাগ। ২০১২সালে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৩৭ ভাগ। ২০১০ সালে এ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ছিল ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
তিন কারণে সিলেটে ফল বিপর্যয় : নতুন আবশ্যিক বিষয় সংযুক্ত, মানবিক বিভাগের যুক্তিবিদ্যায় ২৮ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার কারণেই সিলেটে ফল বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সৃজনশীল পাঠদানের জন্য যতেষ্ট পরিমান প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার গুণগত মান পড়ে গেছে বলে মানে করেন বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান ও সদ্য সাবেক হওয়া বোর্ড সচিব একেএম গোলাম কিবরিয়া তাফাদার। তবে সকলের সহযোগিতায় আগামিতে এ পরিস্থিতি এড়ানো যাবে বলে আশাবাদি তিনি।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবদুল মান্নান খান বলেন, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে শতকরা তিন ভাগ, গনিত ও ইংরেজী বিষয়ে ১৫ ভাগ করে আর মানবিক বিভাগের যুক্তি বিদ্যায় বিষয়ের ২৮ ভাগ শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়েছে। এসব কারণে পাসের হারে সিলেটে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন তিনি।
এব্যাপারে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মমতাজ শামীম বলেন, এবার এমনিতেই বিএনপি-জামায়াতের হরতাল অবরোধ নাশকতার কারণে বার বার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার রোটিন পরিবর্তন করতে হয়েছে। এসব কারণে শিক্ষার্থীরাও ছিলো বিভ্রান্ত। একারণে সারা দেশেই পাসের কার কম। এর প্রভাব সিলেটেও পড়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমাদের ফল একেবারে খারাপ হয়নি। এছাড়া তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়কে এবার নতুন করে আবশ্যিক করা হয়েছে। এবিষয়ে কোনো রকম পাস করেছে শিক্ষার্থীরা এর কারণেও জিপিএ ৫ কমেছে বলে মনে করেন বিদায়ী এই শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান।
চার জেলার মধ্যে এগিয়ে সিলেট : সিলেট শিক্ষাবোর্ডের অধীন চার জেলার মধ্যে ভালো ফলাফল করেছে সিলেট। সিলেট জেলায় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর বাকি তিন জেলা হবিগঞ্জে পাসের হার হচ্ছে ৭৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ সুনামগঞ্জে ৭৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর বোর্ডের গড় পাসের হার ৭৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
সিলেট জেলা : ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সিলেট জেলায় মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ২৯৩। পাস করেছে ১৯ হাজার ৭২ জন। অংশগ্রহণকারী ১১ হাজার ৬৭২ জন ছেলের মধ্যে পাস করেছে ৯ হাজার ৯৭ জন। মেয়ে পরীক্ষার্থী ছিল ১২ হাজার ৬২১ জন। পাশ করেছে ৯ হাজার ৯৭৫ জন। পাশের হার ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশ মেয়ে এবং ৭৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ছেলে। সিলেট জেলায় জিপিএ ৫ এসেছে ১হাজার ৫২ টি। এর মধ্যে ৬৪৪ জন ছেলে ও ৪০৮জন মেয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে। তবে পাশের হারের মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও জিপিএতে এগিয়েছে ছেলেরা।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ জেলায় এবারের এইচএসসিতে মোট শিক্ষার্থী ছিল-১০ হাজার ৬৬৭ জন। পাস করেছে ৭ হাজার ৯৩০ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৯৩৫ জন ছেলে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৩হাজার৬৫১জন এবং ৫ হাজার ৭৩২জন মেয়ে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৪হাজার ২৭৯জন। জেলায় মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭৪ জন। এর মধ্যে ছেলে ৩১টি এবং মেয়ে ৪৩টি পেয়েছে। পাশের হার ৭৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মেয়ে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং ছেলেদের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ জেলায় ছেলেদের থেকে মেয়েরা পাসের হারও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজার জেলায় এবারের এইচএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল-১২ হাজার ৮৮৬ জন। পাস করেছে ৮ হাজার ৬০৮ জন। ৫ হাজার ৫১৬ জন ছেলে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৩ হাজার ৫৫৩ জন। ৭ হাজার ৩৭০ জন মেয়ে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৫ হাজার ৫৫জন। এ জেলায় পাসের হার ৬৬ দশমিক ৮শতাংশ। মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৭৬ জন। এর মধ্যে ছেলেরা ১০৬টি এবং মেয়েরা পেয়েছে ৭০টি। ছেলেদের পাসের হার ৬৪ দশমিক ৪১ এবং মেয়েদের পাসের ৬৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ জেলায় মেয়েরা পাশের হারের দিক থেকে শীর্ষে থেকেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে ছেলেরা।
সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ জেলায় এবারের এইচএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৯ হাজার ৮৫৬ জন। পাস করেছে ৭ হাজার ৪১৮ জন। ৪ হাজার ৫৩৪ জন ছেলে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৩হাজার ৪২০জন এবং ৫ হাজার ৩২২ জন মেয়ে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৩ হাজার ৯৯৮ জন। এ জেলায় মোট জিপিএ ৫ এসেছে ৫৪টি। এর মধ্যে ছেলেরা ১৭টি এবং মেয়েরা ৩৭টি। এই জেলায় পাশের হার ৭৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। ছেলেদের পাসের ৭৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং মেয়েদের ৭৫ দশমিক ১২ শতাংশ। এ জেলায় ছেলেরা পাশের হারের দিক থেকে একটু এগিয়ে থেকেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে মেয়েরা।
সিলেট বোর্ডে ১৩ কলেজের শতভাগ সাফল্য : এবারের এইচএসসি ফলাফলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীন কোনো কলেজ শতভাগ ফেল করেনি। অপর দিকে শতভাগ পাশের হারের কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্টানের সংখ্যা বেড়েছে। সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুল মান্নান খান গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফলাফল পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এবার সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কোনো কলেজ শতভাগ ফেল করেনি। অপর দিকে শতভাগ পাশের হারের কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্টানের সংখ্যা বেড়েছে ৩ টি। এবার শতভাগ পাশের হারের কলেজ সংখ্যা ১৩ টি। ২০১৪ সালে ছিল ১০ টি শিক্ষাপ্রতিষ্টান।