ভাঙনের কবলে অর্ধশতাধিক গ্রাম :

তাহিরপুরে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে চলছে যাদুকাটা নদীর তীরকেঁটে বালু ও পাথর বিক্রি, প্রশাসন নিরব

sunamgonj tahirpur jadukata nodi pic(1)mk-19.06.15জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া,তাহিরপুর(সুনামগঞ্জ)
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে সীমান্তের যাদুকাটা নদীর তীরকেটে প্রতিদিন অবৈধভাবে চলছে বালি ও পাথর বিক্রি। দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ও পাড় কেটে উত্তোলন করা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার বালি ও পাথর। মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে এলাকার নিরীহ লোকদের আটক করে জরিমানা করে। কিন্তু যারা যুগযুগ ধরে যাদুকাটা নদীর দুইতীর কেটে বালি ও পাথর বিক্রি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে,তারা রয়েছে ধরাছোয়ার বাহিরে। তাদের বিরুদ্ধে আজপর্যন্ত নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। অবৈধভাবে যাদুকাটা নদীর দুইতীর কেটে বালু ও পাথর উত্তোলনের কারণে ইতিমধ্যে তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। আর কয়েক হাজার হাজার একর ফসলি জমিসহ সহশ্রাধিক বাড়িঘর ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলিন হয়েগেছে। বর্তমানে নদী ভাঙ্গনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে দুই উপজেলার লক্ষলক্ষ অসহায় মানুষ। কিন্তু দেখার কেউ নেই। যার ফলে যাদুকাটা নদীর তীর কাটার প্রতিযোগীতা দিনদিন বেড়েই চলেছে।
এলাকাবাসী জানায়-তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামেরে মৃত আব্দুল আলীর ছেলে ইউপি সদস্য নোয়াজ আলী,বাদাঘাট ইউপি সদস্য ঘাগটিয়া গ্রামের মনির উদ্দিনের ছেলে সুরহান মিয়া,একই গ্রামের মৃত দিলকুস মিয়ার ছেলে নাজিম উদ্দিন,মৃত আব্দুল মালিকের ছেলে জসিম উদ্দিন,হাজী ছিদ্দিক আলীর ছেলে লাক মিয়া,মৃত নুর জালালের ছেলে হাবিব মিয়া,মৃত তোতা মিয়ার ছেলে আলী চাঁদ,তার ভাই লাল মিয়া,মৃত অহাব আলীর ছেলে ছিদ্দিকুল,মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে আবু লাহাব,মৃত ছিফাত আলীর ছেলে ছত্তার মিয়া,মৃত কুদ্দুছ মিয়ার ছেলে নাছির উদ্দিন,রহিছ মিয়,ঘাগড়া গ্রামের রঞ্জু মিয়া ভান্ডারীর ছেলে কামাল মিয়া,শাহিদাবাদ গ্রামের মৃত হাজী সৈয়দ উল্লাহর ছেলে ফয়েজ উদ্দিন,ছড়ারপাড় গ্রামের জামাল মিয়া,সোহালা গ্রামের মৃত আলহাজ জয়নাল আবেদীনের ছেলে ও জেলা বিএনপির মৎস বিষয়ক সম্পাদক রাখাব উদ্দিন,তার ছোট ভাই জেলা যুবলীগ নেতা আবতাব উদ্দিন,বাদাঘাট ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হাজী ফজলুল হকের ছেলে আব্দুল গনী,তার ছোট ভাই ওমর গনী,সোহালা গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে আকিনুর,ভোলাখালি গ্রামের মৃত কাদির মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন,মাহাতাবপুর গ্রামের মৃত নিদু মিয়ার ছেলে জসিম মিয়া,কুনাটছড়া গ্রামের মৃত ছাদেক মিয়ার ছেলে বাছির মিয়া,একই গ্রামের শুক্রুর মিয়া,মৃত সুলতু সরদারের ছেলে অলী ইসলাম,ঝাড়– ডাক্তরের ছেলে ইউনুছ মিয়া,বাবুল মিয়া,গোলাপ ডাক্তরের ছেলে খোকন মিয়া,জয়দার আলীর ছেলে দানিছ মিয়া ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সত্রিশ গ্রামের গফুর মিয়ার ছেলে কাহার মিয়া,মিয়ারছড় গ্রামের জব্বার মিয়ার ছেলে সেন্টু মিয়া,তারই ভাতিজা সুমন মিয়া,লামাশ্রম গ্রামের বোরহান উদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি সিন্ডিকেডের মাধ্যমে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ও যাদুকাটা নদীর তীরকেটে বালু ও পাথর উত্তোলন করে অবাধে বিক্রি করছে।
ফলে যাদুকাটা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড়,ছড়ারপাড়, ঢালারপাড়,গাঘটিয়া,বড়টেক,বিন্নাকুলি,কাইলকাপুর,মোদেরগাঁও,গরকাটি,গাঘড়া,পাঠানপাড়া, কুনাটছড়া,সোহালা গ্রামসহ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ারছড়,সত্যিস,আমড়িয়া,সিরাজপুর, বাগগাঁও,মনবেঘসহ প্রায় অর্ধশত গ্রাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঠানপাড়া গ্রামের লোকজন বলেন-পাঠানপাড়া খেয়াঘাটের দক্ষিণে নদীর পাড়ে বালখেকো কামাল মিয়া অফিস তৈরি করে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পুলিশকে নিয়ে চা চক্র বসিয়ে নদীর তীরকেটে বালি বিক্রির ভাগভাটোয়ারা করেন। জামালগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী আশরাফ উদ্দিন,মিলন মিয়া,সোহরাব হোসেন বলেন-যাদুকাটা নদীর পাড়কেটে বালু নেওয়ার জন্য নদীরপাড় মালিক দাবীদারদেরকে প্রতিফুট বালুর জন্য দিতে হয় ২টাকা,বারকী শ্রমিকদের সাড়ে ৪টাকা,৫ থেকে ৭হাজার ফুট বলগেইট স্ট্রিলবডি ইঞ্জিনের নৌকার জন্য ৩হাজার টাকা হারে চাঁদা দিয়ে হয় বাদাঘাট পুলিশ ক্যাম্পের নামে।
এছাড়া প্রতিটি ড্রেজার মেশিনের জন্য প্রতিরাতে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের আব্দুল কাইয়ুম আওয়ামীলীগের নামভাঙ্গীয়ে ও তাহিরপুর থানা পুলিশের নামে নিচ্ছে ২হাজার ৫শত টাকা।
লাউড়েরগড় গ্রামের মধু মিয়া,জয়নাল মিয়া,ঘাগটিয়া গ্রামের মঞ্জু মিয়া,আবুল মিয়া বলেন-প্রতিদিন ৫ থেকে ৭হাজার ফুট ওজনের ৩০থেকে ৪০টি স্ট্রিলবডি ইঞ্জিনের নৌকায় করে প্রায় ২থেকে আড়াই লক্ষ ফুট বালু বিক্রি পাড় কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। বালু বিক্রির সময় পুলিশে চাঁদার টাকা না দিলে নৌকা আটক করাসহ মোবাইল কোট ও মামলার ভয় দেখায়। আর যাদের সাথে বাদাঘাট পুলিশ ক্যাম্পের মৌখিক চুক্তি আছে তাদেরকে অভিযানের আগে মোবাইল করে জানিয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিন,লাল মিয়া,নৌকার সর্দার জলিল মিয়া,আকিক মিয়া বলেন-ঘাগটিয়া গ্রামের সামনে বিশাল বালুর স্তুপ ছিল। একে সবাই বড়টেক ডাকত। কিন্তু বালুখেকোদের কারণে গতকয়েক বছর এই বড়টেক তাহিরপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে।
গাঘটিয়া গ্রামের মজিবুর রহমান,আলাল মিয়া,দূরবীন শাহ,আবুল আজাদ বলেন-গুচ্ছ গ্রামে শতাধিক অসহায় গৃহহারা ও দরিদ্র পরিবারকে সরকার ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়ে ছিল। কিন্তু বালু খেকোরা নদীরতীর কেটে বালু বিক্রির কারণে ওই গ্রামের ১০-১৫টি ঘরসহ ১টি স্কুল ও ১টি মসজিদ নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। আমরা তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করি বলে আমাদের উপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করছে। তারা পুলিশের উপস্থিতিতেই নদীরপাড় কেটে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে। এখানে রক্ষকই হয়েছে বক্ষক। তাই যুগযুগ ধরে এখানকার সাধারণ জনগন অসহায়।
স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেন বলেন-আমি নদীর তীর কেটে বালু উত্তোলনের ফটো তুলতে গেলে যুবদল নেতা কামালের সহযোগী নাজিম,জসিম ও সুরহানসহ বেশ কয়েক এসে বাঁধা দেয়। এবিষয়টি থানার ওসিকে জানালে তিনি দেখবেন বলে আমাকে আস্বাশদেন।
এব্যাপারে বালু খেকো কামালের ব্যক্তিগত মোবাইলে বারবার ফোন করার পরও নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এব্যাপারে ইপি সদস্য নোয়াজ আলী বলেন-নদীরপাড় কেটে বালি ও পাথর বিক্রি করছে আওয়ামীলীগের লোকজন। আমি বিএনপি করি বলে আমাকে বিভিন্নভাবে ফাসানোর চেষ্টা করে।
মিয়ারচর গ্রামের সাফিল মিয়া,সাত্তার মিয়া বলেন-আওয়ামীলীগ ও বিএনপির লোকজন সন্ধ্যা থেকে সারারাত নদীর তীর কেটে ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে মিলেমিয়ে বালি ও পাথার উত্তোলন করে বিক্রি করে লাখলাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা গ্রামবাসী মিলে বাঁধা দিলে আমাদের মারপিট করে মামলা দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দেয়।
যাদুকাটা নদীরতীর রক্ষা কমিটির উপদেষ্টা আলহাজ মোশারফ হোসেনের বলেন-আমি নদীর তীর কাটা বন্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি এর প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগীতা না পাওয়ার কারনে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
তাহিরপুর থানা ওসি শহিদুল্লাহ বলেন-আমাদের পক্ষ থেকে এব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়া হবেনা কিন্তু স্থানীয় লোকজনের সহযোগীতা ছাড়া নদীর পাড় কাটা বন্ধ করা সম্ভব না। এব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন-যাদুকাটা নদী তীর রক্ষা করার জন্য আমরা অভিযান চালিয়ে নৌকা ও লোক আটক করে জরিমানা করাসহ অনেককে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছি। এব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।