সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নিখোঁজ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে সোমবারই গ্রেফতার হয়েছিলেন ভারতের মেঘালয় রাজ্য পুলিশের হাতে। পরে পুলিশই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মেঘালয় রাজ্যের দুটো সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য এমনটাই। ‘বাংলাদেশি ম্যান হেল্ড’ শিরোনামে একটি সংবাদ মঙ্গলবার শিলং টাইমস নামের স্থানীয় একটি পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। ছোট্ট সে সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি নাগরিক সালাহ উদ্দিন আহমেদকে (৫৪) শিলংয়ের গলফ লিংক থেকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’ তবে ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে নর্থইস্ট টুডে নামের একটি সংবাদ মাধ্যমে। ছবিসহ প্রকাশিত সংবাদে বর্ণিত হয়েছে গ্রেফতার ঘটনার পূর্বাপর।
সোমবার সকালে মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের গলফ লিংক এলাকায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরাফেরা করছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। সন্দেহ হলে পুলিশ তাকে আটক করে। এ সময় পুলিশ তার পরিচয় জানতে চায়। নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা হিসেবে। তবে তিনি কি করে শিলং এলেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘আমি জানি না’।
পরে পুলিশই তাকে ভর্তি করে মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্স নামক মানসিক (এমআইএমএই) হাসপাতালে।
মেঘালয়ের পশ্চিম খাসি হিলের পুলিশ সুপার এম খারক্রাং বলেন, নিয়মমতো তাকে আদালতে হাজির করার কথা থাকলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন তিনি শিলং সিভিল হসপিটালে ভর্তি আছেন।
খারক্রাং বলেন, সালাহউদ্দিনকে আটকের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে যাচাইয়ের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে জানানো হয়েছে। তিনি তথ্য দেন, ইতোমধ্যেই সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদেশী আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা হয়েছে।
এমআইএমএইএইচৃএনএস’র অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট ড. ডি সিংকন বলেন, সোমবার দুপুরে পুলিশের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আহমদ নামের একজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। প্রাথমিক পরীক্ষার আমাদের চিকিৎসকরা তাকে মানসিকভাবে সুস্থই মনে করেন। তবে তার হৃদরোগের কারণে তাকে শিলং সিভিল হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।
শিলং শহরের পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট বিবেক সিয়াম বিবিসিকে বলেন, “একজন ব্যক্তি উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন – এই খবর পেয়েই তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়।”
মি.সিয়াম বলছেন, তার দেহে কোনো চোট বা আঘাতের চিহ্ন ছিল না, কিন্তু তিনি নিজে হৃদরোগ আর লিভারের সমস্যা রয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।তিনি বলেন, “বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও তিনি গুছিয়ে দিতে পারছিলেন না। তাই তাকে একটি মানসিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে।”
মি.আহমেদ সরকারি মানসিক হাসপাতাল ‘মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস (মিমহ্যানস) এ অবস্থান করছেন। তাকে এখন অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান সিয়াম। পুলিশের ওই কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন,“তার ভারতে আসার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এখানে তিনি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, সেটা তাকে জেরা করার পরেই বোঝা যাবে। কিন্তু এখন তিনি অসুস্থ বলে জেরা করতে পারিনি।” জানিয়েছেন শিলংয়ের এসপি।পুলিশ বলছে, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।
যেভাবে নিখোজঃ
১০ই মার্চ গভীর রাত। উত্তরার একটি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। তার পরিবারের সদস্যরা এত দিন দাবি করে আসছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তাকে ধরে নিয়ে গেছেন। ওই বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরাও একই তথ্য জানান। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল।
এদিকে, অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন, তাদের দিল্লি প্রতিনিধি রঞ্জন বসুর বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলছে, আসলে সোমবার ভোর থেকেই এ এক অচেনা ব্যক্তি শিলংয়ের পুলিশকে যেভাবে নাজেহাল করে রেখেছেন, তেমন অভিজ্ঞতা তাদের আগে হয়নি বললেই চলে। যখন গলফ ক্লাবের সামনে অচেনা লোককে দেখে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন, তখন সেখান দিয়েই যাচ্ছিল পুলিশ পেট্রলের একটি জিপ। টহলদার বাহিনী লোকটিকে ধরে নিয়ে কাছেই শিলংয়ের প্যাসটিওর বিট হাউস থানাতে নিয়ে যাওয়ার পরেই নাটকের শুরু!
নাটক, কারণ ওই ভদ্রলোক থানায় গিয়েই বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন আমি কিন্তু বাংলাদেশের একজন ভিআইপি। আমি সে দেশে ক্যাবিনেট মিনিস্টারও ছিলাম!’ এদিকে ভদ্রলোকের পকেটে একটা কাগজ পর্যন্ত নেই। কোন টাকা-পয়সা দূরে থাক, পকেটে একটা মানিব্যাগও নেই, ফলে যথারীতি শিলংয়ের পুলিশ প্রথমে তার কথা একেবারেই বিশ্বাস করেনি, পাগলের প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দিয়েছিল। ‘আচ্ছা বুঝলাম আপনি বাংলাদেশে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু বর্ডার পেরিয়ে আপনি শিলং অবধি এলেন কি করে?’ পুলিশের এ প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক আবার ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মুখে কোন কথা জোগায় না। ওনার অবস্থা দেখে থানাতেই সিদ্ধান্ত হয় ইনি নিশ্চয় মানসিক ভারসাম্যহীন আর তার পরই পুলিশ তাকে শিলংয়ের মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল সায়েন্সেসে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করে। মিমহ্যানস শিলংয়ে মানসিক প্রতিবন্ধীর হাসপাতাল বলেই পরিচিত। সালাহউদ্দিন আহমেদের গতি হয় সেখানেই।
‘তবে একটা কথা কি, ভদ্রলোক বাংলাদেশী কি-না কিংবা সালাহউদ্দিন আহমেদ কিনা সেটা কিন্তু আমরা এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। ওনার কাছে কোন কাগজপত্র নেই। ওর কোন আত্মীয়-পরিজন এসে ওকে এখনও চিহ্নিতও করেননি। ফলে আপাতত ওনাকে একজন বিদেশী নাগরিক বলে চিহ্নিত করে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার জন্য ফরেনার্স অ্যাক্টে আমরা রীতিমাফিক মামলা রুজু করেছি’, জানাচ্ছিলেন পুলিশপ্রধান এম খারক্রাং।
তাহলে কিভাবে জানা গেল সালাহউদ্দিন আহমেদ শিলংয়ের হাসপাতালে ভর্তি আছেন? আসলে মিমহ্যানসে ডাক্তারদের চিকিৎসায় গতকাল রাত থেকেই অল্প অল্প করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার লক্ষণ দেখাতে শুরু করেন তিনি। তারপর গতকাল সকালে তিনি মিমহ্যানসের ডাক্তারদের জানান, ঢাকায় থাকা স্ত্রীর টেলিফোন নম্বর তার মনে পড়েছে, সেখানে তিনি ফোন করে কথা বলতে চান। এর পরই তিনি ঢাকায় স্ত্রী হাসিনা আহমেদকে ফোন করে জানান, তিনি ভাল আছেন, মেঘালয়ের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।
সোমবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন শিলং গলফ ক্লাবের সামনে থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে, তখন তিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় থাকলেও তার শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তবে মিমহ্যানসের চিকিৎসকরা এদিন তাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন তার হৃদযন্ত্রে কিছু দুর্বলতার লক্ষণ আছে। ফলে মানসিক হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নিয়ে এদিন বিকালে তাকে শিলং সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কিন্তু সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধারের রহস্যটা যে এখনও ধোঁয়াশায় ঘেরা, তা হলো তিনি শিলংয়ে উদয় হলেন কিভাবে? পুলিশ সুপার আমার কাছে স্বীকার করেছেন, ব্যাপারটা তাদেরও ধন্দে রেখেছে। আসলে শিলংয়ের সবচেয়ে কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের ডাউকী সেটাও প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ মাইল দূরে। প্রাথমিকভাবে মেঘালয় পুলিশ অনুমান করছে, রোববার রাতে সেই ডাউকীর কাছে সীমান্ত পেরিয়েই ভারতে ঢোকেন সালাহউদ্দিন আহমেদ কিংবা তাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়! তারপর সেখান থেকে কোন বাস বা ভাড়ার টেম্পোয় চেপে তিনি সোমবার ভোরে শিলংয়ে পৌঁছান এবং কিছুক্ষণ পর পুলিশের কাছে ধরা পড়েন।
কিন্তু এ সময়টাও তিনি আদৌ স্বাভাবিক বা প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিলেন না। খুব জোরালো ইলেকট্রিক শক খেলে বা অন্য কোন শক থেরাপির মানুষের যেমন সাময়িক মস্তিষ্ক বৈকল্য হয়, তার মধ্যেও সে রকমই লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। মিমহ্যানসের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ওই রোগীকে সমপ্রতি ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে বলেই তারা অনুমান করছেন। এখন সালাহউদ্দিন আহমেদের ব্যাপারটি নিয়ে মেঘালয়ের পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিভাবে মামলা এগোবে এবং তাকে নিয়ে কি করা হবে মেঘালয় সরকার বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কথাবার্তা বলছেন। তার পরিচয় সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেই যোগাযোগ করা হবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গেও। খুব সহজে যে এ মামলার জট খুলবে না তা বোঝাই যাচ্ছে।