৪২ বছর পর আলোর মুখ দেখছে সীমান্ত চুক্তি

LBR1430809418সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ ৪২ বছরের অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তিটি অবশেষে আলোর মুখ দেখতে চলেছে। সীমান্ত চুক্তির বিলটি কাল ভারতের রাজ্যসভায় এবং পরশু লোকসভায় চুড়ান্ত অনুমোদনের লক্ষ্যে উত্থাপিত হচ্ছে। এই বিলে আসামকে বাদ রাখার যে চেষ্টা চলছিল, তা কংগ্রেসের প্রবল আপত্তির মুখে অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার।
গত রাতে সোমবার) অনুষ্ঠিত বিজেপির শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে বিলটি অপরিবর্তিতভাবে পাশের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকেও অপরিবর্তিত বিলটিতে অনুমোদন দেওয়া হয়। বিজেপির এই সিদ্ধান্তের ফলে সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকলো না।
সীমান্ত চুক্তিটি ভারতীয় পার্লামেন্টে চুড়ান্ত অনুমোদনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও আসাম রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। এই চুক্তির ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি ইতিমধ্যে তার সম্মতি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, কংগ্রেসের চাপে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং আসাম রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব আসামকে বাদ দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আগামী ৭ মে সীমান্ত বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টে চুড়ান্ত অনুমোদন পেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরসূচি চূড়ান্ত করবে দুই দেশ। আগামী জুনেই ঢাকা সফরে আসতে চান নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তিস্তা বা সীমান্ত যেকোন একটি চুক্তি করেই ঢাকা সফরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে, সীমান্ত বিলটি নিয়ে তড়িঘড়ি করার অন্যতম কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জুন মাসে ঢাকা সফর। অন্যদিকে, লোকসভার অধিবেশন ৮ মে শেষ হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত ১১৯তম সংবিধান সংশোধন বিলটি পার্লামেন্টে পাশ না হলে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে যাবে। এ লক্ষ্যে সীমান্ত বিল নিয়ে গতকাল রাতেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর অশোকা রোডের বাসভবনে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আসাম বিজেপির সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যসহ দলের সকল সাংসদকে জরুরি তলব করা হয়। এই বৈঠকেই সীমান্ত বিল অপরিবর্তিতভাবে পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে আসাম থেকে নির্বাচিত দলের সব সাংসদের সামনে সীমান্ত বিলের খুঁটিনাটি বিষয়, কংগ্রেসের আপত্তি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়। চুক্তি থেকে আসামকে বাদ না দিতে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের চিঠি এবং কংগ্রেসের অনমনীয় ভূমিকার কথাও বৈঠকে ব্যাখ্যা করা হয়। এতে বলা হয়, এই আন্তর্জাতিক চুক্তি ৪২ বছর ধরে ঝুলে আছে। আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে দেশের মর্যাদাও জড়িত। চুক্তি থেকে আসামকে বাদ দিলে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চুক্তিটি অপরিবর্তিতভাবে অনুমোদন দিলে আসামের ওপর এর যে চাপ আসবে, তা বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। বিজেপির আসাম রাজ্য সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য জানান, আমরা চেষ্টা করেছিলাম আসামকে আপাতত বাইরে রেখে সীমান্ত বিলটি পাশ করাতে। বিজেপি যে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এই সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ রাইজিংবিডিকে জানান, সীমান্ত চুক্তিটি বাস্তবায়ন না করে ভারতের উপায় ছিল না। কারণ, এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। এই চুক্তিটি ৪২ বছরে বাস্তবায়ন না করায় ভারতের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে নষ্ট হয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা ছিল চুক্তি করে তা বাস্তবায়ন করে না ভারত। তবে এই চুক্তিটি বাস্তবায়নে যতদিন দেরি হয়েছে তা ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক কারণে। এটি ১৯৪৭ সালেই বাস্তবায়ন হওয়া উচিত ছিল। তাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এতদিনে আরো ভালো হতো। ভারতবিরোধী প্রচার এ দেশে কম হতো। তারাই এই সুযোগ করে দিয়েছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এই চুক্তির ব্যাপারে বরাবরই একটি সংশোধনী চেয়েছিল, যা ২০০৯ সালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে সম্পন্ন হয়েছে। এখন এই চুক্তি নিয়ে দেরি করার কোনও কারণ নাই। এরপর সেদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে কংগ্রেস সরকার পারেনি। এখন সেদেশের পার্লামেন্টে বিজেপির এক-তৃতীয়াংশ সমর্থন রয়েছে। তাই না পারার কোনো কারণ নাই। তাছাড়া প্রায় ৫৫ হাজার ছিটমহলবাসী মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে তারা একটি স্থায়ী ঠিকানা পাবে। তবে আসামকে চুক্তি থেকে বাদ দেওয়াও ছিল ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক খেলা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপরিপক্কতাও ছিল এ ব্যাপারে। তাই আজ-কাল করে চুক্তি বাস্তবায়নে কেবল প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি হওয়া ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে দেরিতে হলেও দীর্ঘদিনের এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন উভয় দেশের জন্য ইতিবাচক বলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. আমেনা মহসীন রাইজিংবিডিকে জানান, সীমান্ত চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে তা উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক হবে। হাজার ছিটমহলবাসী যে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে এতদিন কাটাচ্ছে তার অবসান হবে। দীর্ঘদিনের এই বিরোধপূর্ণ ইস্যুটির কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া সীমান্ত অনিষ্পত্তি থাকলে সেখানে চোরাচালান, মানবপাচারসহ নানা ধরনের অবৈধ কাজ হয়ে থাকে। চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে উভয় দেশের সীমান্তে আরো নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব হবে। সীমান্তে বিদ্যমান উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমে আসবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি, ছিটমহলের মতো মানবিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। কাজেই চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।’
উল্লেখ্য, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের কাজ শুরু হবে। এই চুক্তির অধীনে ভারত ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। এই ছিটমহলগুলোর আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের কাছে হস্তান্তর করবে ৫১টি ছিটমহল, যার আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। এসব ছিটমহলে ৫৫ হাজার অধিবাসী দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া দুই দেশের বিরোধপূর্ণ জমি হস্তান্তরের ফলে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে পাবে ২ হাজার ৭৭৭ দশমিক ০৩৮ একর জমি এবং বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে পাবে ২ হাজার ২৬৭ দশমিক ৬৮২ একর জমি। চুক্তিটি বাস্তবায়নের ফলে দু’দেশের মধ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজও করা সম্ভব হবে।