ভাঙলো ফিরোজার নীরবতা, খালেদার অর্জন কী?

firoja_Khaleda House
দীর্ঘ তিনমাস পর খুললো তালা, ভাঙলো নীরবতা

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ গত ৩ জানুয়ারি থেকে প্রায় তিন মাস সরকারের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ এবং বাকি সময়টা স্বেচ্ছা অবরোধে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই সময়টা গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে কাটিয়েছেন তিনি। প্রথমে সরকারই তাকে সেখানে থাকতে বাধ্য করলেও পরবর্তীতে বাড়ি ছেড়ে কার্যালয়ে থাকাটা আন্দোলনের অংশে পরিণত হয়।
এই দীর্ঘ সময় পর রোববার কার্যালয় থেকে বের হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যান খালেদা জিয়া। সেখান থেকে জামিন নিয়ে চলে যান তার ভাড়া বাসা ফিরোজায়। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত এ বাসায় এতোদিন ছিল সুনশান নীরবতা। এতোটাই নির্জন যে ঘুঘু বাসা বেঁধেছিল। তিন মাস পর এই ফিরোজার নীরবতা ভাঙলো।
একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেই দাবিতে এখান থেকেই হরতাল-অবরোধ-বিক্ষোভের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে একে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কর্মসূচিতে পর্যবসিত হয়েছে।
অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও নিয়মিত বিরতিতে হরতালের এই তিন মাসে পেট্রোলবোমা, আগুন, ককটেল, গুলি, হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনায় কমপক্ষে ১৩৭ প্রাণহানি ঘটেছে।
এখন পরিস্থিতি শান্ত হলেও অর্থনৈতিক ক্ষতি অব্যাহত আছে। কর্মসূচি চলাকালে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সারা দেশে মোট অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক, দিনমজুর, হকার ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। খাতওয়ারি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার পোশাক খাত, পর্যটন, পরিবহন, ক্ষুদ্র দোকানি, কৃষি ও শিল্পসহ ১৬ খাতের ব্যবসায়ীরা।
তবে ১৮ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিলকে কেন্দ্র করে এই দুই জেলাকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়। মূলত এরপর থেকেই দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ তুলনামূলকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া নাশকতা, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনাও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি কমে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়, মামলা-হামলা ও ক্রসফায়ারের ঘটনাও। বলতে গেলে হরতাল-অবরোধের ৮০ দিন পার হওয়ার পর গত দুই সপ্তাহে দেশের কোথাও পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি।
চলমান সহিংসতার মধ্যে জাতিসংঘ ও কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তৎপর হয়েছিল সুশীল সমাজও। কিন্তু সরকার বারবারই সহিংসতার পরিসংখ্যান ও বিভৎসতা সামনে এনে বিএনপির যেকোনো সংলাপের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে। হরতাল-অবরোধের আড়ালে এসব সহিংসতা চললেও বিএনপি এর দায় অস্বীকার করেছে এবং সহিংসতা প্রশমনে কর্মসূচি পরিবর্তনের কোনো কৌশল নেয়নি।
তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে আসার পর অবস্থান পরিবর্তন করলেন খালেদা জিয়া।
এই তিন মাসে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। কার্যালয়ে অবস্থানকালে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছেন খালেদা জিয়া। বিশেষ করে তাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে প্রাণহানি, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু ও বিশ্ব ইজতেমাতেও কর্মসূচি শিথিল না করা, ছেলের মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কার্যালয়ে ঢুকতে না দেয়া, মহান শহীদ দিবসে শহীদ মিনার এবং মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে স্মৃতিসৌধে না যাওয়ায় খালেদা জিয়া প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছেন।
এছাড়া বিএনপি জোটের অবরোধ হরতাল শেষ পর্যন্ত কার্যত অকার্যকর কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। কর্মসূচি ঘোষণার পর নেতাকর্মীরা মাঠে থাকতে পারেনি। খালেদা জিয়ার বারবার আহ্বান সত্ত্বেও নেতাকর্মীরা মাঠে নামেননি। মামলা হামলায় আক্রান্ত হয়ে নেতাকর্মীদের অধিকাংশ রয়েছেন কারাগারে এবং আত্মগোপনে। সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে তালা ঝুলছে। ফলে জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তারা। তিন মাস মাস পর গত শনিবার সন্ধ্যায় নেতাকর্মীরা তালা কেটে দলের প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করেছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, খালেদা জিয়া গত তিন মাসের আন্দোলনে যতটা না সমালোচিত হয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি এখন অনুতপ্ত। এই বোধ থেকে তিনি হয়তো আন্দোলন কৌশল পরিবর্তনের পথ খুঁজছিলেন। আর মেঘ না চাইতে বৃষ্টি হয়ে এসেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
ঢাকা ভাগ করা নিয়ে বিএনপির প্রবল আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিভক্ত ঢাকায় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে দলটি। একাংশে অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র এবং সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসকে চূড়ান্ত করলেও উত্তরে এখনও প্রার্থী ঠিক করতে পারেনি।
তিন মাসের অর্জন প্রশ্নে খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব ও বিএনিপর সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলন চলমান রয়েছে। হরতাল-অবরোধ অকার্যকর হওয়ায় তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করেছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়া কৌশলেরই অংশ। খালেদা জিয়ার আন্দোলনে দেশি-বিদেশি মহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে এবং তারা সুষ্ঠু সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।’