ঘুষ নিয়ে ঘুষাঘুষি : ম্যাজিস্ট্রেটের ইন্ধনে ৪ আইনজীবীকে মারধর

মারধর করার নির্দেশ দিচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট (ছাই রঙের শার্ট)
মারধর করার নির্দেশ দিচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট (ছাই রঙের শার্ট)

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ঢাকার জেলা প্রশাসকের ইন্ধনে তারই কার্যালয়ের জুডিশিয়াল মুন্সীখানার সহকারী রফিকের নেতৃত্বে ঢাকা বারের চার আইনজীবীকে দরজা বন্ধ করে চরম নির্যাতন করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় জুডিশিয়াল মুন্সীখানার অফিস সহকারী উকিল উদ্দিন প্রামাণিকের সঙ্গে অ্যাডভোকেট কবিরের জামিননামা দাখিলকে কেন্দ্র করে ওই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
নির্যাতিত আইনজীবীদের কাছ থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার অ্যাডভোকেট কবির হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিনের আদেশনামা দাখিল করতে গেলে জুডিশিয়াল মুন্সীখানার অফিস সহকারী উকিল উদ্দিন প্রামাণিকের সঙ্গে ঘুষ লেনদেন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ওই আইনজীবী তার পকেটে থাকা ১০ হাজার টাকা বের করে দিয়ে তার কাজটি করে দেয়ার অনুরোধ করেন, যাতে তার মক্কেল জেল থেকে বের হতে

সবক’টি দরজার বন্ধ করে আইনজীবীদের পেটানো হচ্ছে
সবক’টি দরজার বন্ধ করে আইনজীবীদের পেটানো হচ্ছে

পারেন। এসময় ওই স্থানে অন্য কাজে উপস্থিত অ্যাডভোকেট জীবন অফিস সহকারী উকিল উদ্দিন প্রামাণিকের এরূপ জুলুমের প্রতিবাদ জানান।
এরপর সেখানে এই দুই আইনজীবীকে চরমভাবে হেনস্থা করে দু’জনকে দুই রুমে আটকে রাখা হয়। এসময় অ্যাডভোকেট জীবন মোবাইলে তাদেরকে আটকে রাখার খবরটি জানান অ্যাডভোকেট কাউসার হাসানকে। খবর পেয়ে অ্যাডভোকেট হাসান আর দুই আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম রাব্বানী ও অ্যাডভোকেট আনিসকে সঙ্গে নিয়ে আটক দুই আইনজীবীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। একই সময় খবর পেয়ে সেখানে যান আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুবীর নন্দী দাস।
এসময় এগিয়ে আসা এই চার আইনজীবীকে নির্যাতন করেন ঘুষ দাবিকারী অফিস সহকারী প্রামাণিকের পিয়ন রফিক। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ডিসি অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদেরকে মোবাইল ফোনে ডেকে জড়ো করতে থাকেন। অল্প সময়ের

ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার (ছাই রঙের শার্ট পরিহিত)
ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার (ছাই রঙের শার্ট পরিহিত)

মধ্যেই ৪০-৫০ জন কর্মচারী একত্রিত হয়। তারা জেলা প্রশাসন ভবনের সবক’টি ফটক বন্ধ করে দিতে থাকে। এরপর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অ্যাডভোকেট কাউসার হাসানের ওপর প্রথমে হামলা চালায়। এতে ইন্ধন যোগান ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার।
হামলার স্বীকার আইনজীবীরা অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়ে নিচে নেমে এলেও তাদেরকে জেলা প্রশাসন ভবনের নিচের খোলা চত্বর থেকে আবারও ধরে নিয়ে ‍যাওয়া হয়। সেখানে অ্যাডভোকেট কাউসার ও সুবীর নন্দীকে মারধর করা হয়। তাদের ‍মুখে, বুকে দুই পাঁজরে সজোরে আঘাত করা হয়েছে। বলপেনের চোখা অংশ দিয়ে সজোরে আইনজীবীদের কানের পাশে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়েছে।
এসময় তাদেরকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার। ওই ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতিত আইনজীবীদের মধ্যে থেকে অ্যাডভোকেট সুবীর নন্দী দাসকে নিয়ে আটকে রেখে তার ও তার বন্ধুদের নামে পেট্রোল বোমা মারা, ভাঙচুর ও নাশকতার মামলায় জড়ানোর নির্দেশ দেন।
এরপর ঘটনা জানাজানি হতে ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হন কয়েকশ আইনজীবী। তারা ঘেরাও করেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। বিচার দাবি করেন আইনজীবী নির্যাতনের।
এসময় ঘটনাস্থলে হাজির হন ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকীসহ বারের বর্তমান ও সাবেক নেতারা।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভেতরেও ঢাকা বারের নেতাদের সামনে আইনজীবীদের বিষয়ে প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় গালাগালি করেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট।
আইনজীবীদের চরম উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় এজন্য জেলা প্রশাসক বিষয়টি রোববারের মধ্যে ত্বরিত সমাধানের আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসকের সম্মানার্থে আইনজীবী নেতাদের আহ্বানে ফিরে আসেন ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা।
কিন্তু রোববারেও বিষয়টি সমাধানের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক কোনো উদ্যোগ নেননি বলে জানান ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী।
এ ঘটনায় চরমভাবে মর্মাহত ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, মাঝে মাঝেই জেলা প্রশাসনের কর্মচারীদের হাতে আমাদের আইনজীবীরা ‍নিগৃহীত হয়ে থাকেন। এর আগে আরও কয়েকবার এমন ঘটনা ঘটেছিল বলেও জানান। গত ২০১০ সালে ঢাকা বারের নির্বাচনের দিন পনের আগে অ্যাডভোকেট হাশেমীর ওপর হামলার ঘটনায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক ঢাকা বারে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করে গেছেন বলেও জানান অ্যাডভোকেট হিরু।
এদিকে আইনজীবীদের ওপর হামলার বিষয়ে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, তিনি দুই দিনের ছুটিতে বাইরে আছেন। অফিসে ফিরে একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটটের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেবেন বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বার নেতাদের কিছু জানিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি ‘না’ সূচক জবাব দেন।
ন্যক্কারজনক এই ঘটনা দূর থেকে ভিডিও করেছেন অ্যাডভোকেট এইচএম মাসুম। মোবাইলে ভিডিও ধারণের সময় হামলার নেতৃত্ব ও নির্দেশদাতা ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমারের চোখাচোখি হয়ে গেলে ভিডিও ধারণকারীকে আটক করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এসময় ওই আইনজীবী প্রমাণ রক্ষা ও হামলা এড়াতে প্রাণপণে দৌড়ে পালান। তিনি নিজে সাংবাদিকদের কাছে ওই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চালানো নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন।
এদিকে আগামীকাল সোমবার থেকে আইনজীবী নির্যাতনের প্রতিবাদে মিছিল, সমাবেশসহ এবং পরে আদালত বর্জনের মতো কঠোর কর্মসূচিও আসতে পরে বলে জানা গেছে।