হৃদয়বিদারক বিদায়

Inspector Mostafiz Rana and Akash Chowdhuryআকাশ চৌধুরীঃ দেশে প্রায়ই অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় অনেক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যু সারা জীবন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের পীড়া দেয়, কাঁদায়। অথচ এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোর জন্য যারা দায়ী, তাদের সঠিক বিচার হয় না। জনগণের নিরাপত্তার জন্য যারা বিরামহীন ভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, সেসব পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনের সময় মৃত্যুর পর তার পরিবারের খোঁজখবর ক’জনই বা রাখেন। সরকার থেকেও তেমন অনুদান দেয়া হয় না। ফলে এসব মৃত্যু খুবই হৃদয়বিদারক। আর এমনই একটি মৃত্যু হয়েছে সিলেট জেলার ওসমানীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোস্তাফিজুর রহমানের। বুধবার গোয়ালাবাজারে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় চলতি বছরই। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে প্রথম যেদিন যোগদান করেন সেদিনই তার সঙ্গে কথা হয়। ওইদিন সুরমা নদীর পাড়ে বৈশাখী মেলা চলছিল। ডিআইজি অফিসে তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। সন্ধ্যার পরে আমি মেলায় যাই। হঠাৎ দেখি তিনি একটি চট্পটি দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি পরিচিত মনে হওয়ায় তার কাছে যাই এবং নিশ্চিত হই তিনি পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর। বললেন, সিলেটে নতুন এসেছেন। আমি তাকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিই এবং পার্শ্ববর্তী একটি দোকানে বসে থাকা টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন-সিলেট এর সভাপতি এস সুটন সিংহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন মন্জু। আমাকে দেখে গাড়ি থামানোর পর তার সঙ্গেও পরিচয় হলো। কিছুক্ষণ পর সেখানে হাজির হলেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-সিলেট এর উপ-পরিচালক মো. আতাউর রহমান। আমি তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর একটি দোকানে বসে গল্প করছিলাম। আতাউর সাহেব চলে যাওয়ার পর মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক থাকার বিষয়ে গল্প করলেন। সেলফোনে কথা বলিয়ে দেন তার সর্বশেষ কর্মস্থল খাগড়াছড়ির কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। তার বন্ধুসুলভ এবং উদার মানসিকতার কথাবার্তায় বুঝলাম তিনি সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু। আমার খুব ভালো লাগলো তাকে। জানতে চাইলাম সিলেটের পোস্টিংয়ের কথা। অবশ্য আমার জানা আছে যে, স্থানীয় সংসদ সদস্যর ইচ্ছা ছাড়া কোনো থানায় ওসি পোস্টিং দেয়া খুবই কঠিন-এমন রেওয়াজ রয়েছে। মোস্তাফিজুর আমাকে বললেন, সবেমাত্র সিলেট রেঞ্জে যোগদান করলাম। এখন কর্তৃপক্ষ কোথায় দেন তা জানা নেই। যা হোক, তিনি আমার কাছে দৈনিক যুগান্তরের সিলেট ব্যুরো প্রধান রেজওয়ান আহমদের সেলফোন নম্বর চাইলেন। বললেন, খাগড়াছড়িতে যুগান্তর প্রতিনিধির সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক। ওইদিন রাতে আমরা নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে চলে যাই।
পরদিন সন্ধ্যার পর আমাকে ফোন করেন মোস্তাফিজুর রহমান। সুরমা নদীর তীরে বসে আমি, সুটন ও শেখঘাট এলাকার প্রদীপ বাবু গল্প করি। এভাবে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। একপর্যায়ে একটা গভীর সুসম্পর্ক হয়ে উঠে। জানালেন, তার মনের দুঃখের কথা। কয়েক মাস হোটেলে অবস্থান করে আছেন, অথচ কোনো থানায় পোস্টিং হচ্ছে না রাজনৈতিক সুপারিশের অভাবে। আবার কোথাও থেকে সুপারিশ আসলেও তা কাজ হচ্ছিল না। একদিন বললেন, ডিআইজি অফিসে হাজিরা দেয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই, বিয়ানীবাজার থেকে ঘুরে আসার জন্য। আমি দেখলাম, অত্যন্ত নিরহংকারি ও ভালো মনের অধিকারী তিনি। তাই রাজি হলাম। বিয়ানীবাজার থানায় যাওয়ার পর তৎকালীন ওসি আবুল কালাম আজাদ আমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। টেবিলে বসে মোস্তাফিজুরের একই আক্ষেপ, দুই মাস হয়ে গেলো-কোথাও পোস্টিং হচ্ছে না। তখন জানতে পারি যে, কোনো এক রাজনৈতিক নেতা ওসমানীনগর থানার ওসি করার আশ্বাস দিয়ে তাকে সিলেটে আনেন। তবে রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে তা হয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছিল না। এরই মধ্যে তার পোস্টিং হলো সিলেট জেলায় ও যোগদান করেন ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে বিয়ানীবাজার থানায়। এর আগে আমরা একদিন জাফলং বেড়াতে যাই। হাস্যোজ্জল মোস্তাফিজুর রহমান মোবাইলে একের পর এক ছবি তুলছিলেন। বিয়ানীবাজার যাওয়ার পর তার ব্যস্ততার কারণে আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে সেলফোনে যোগাযোগ হতো। সবসময় হাসিখুশি মনে কথা বলতেন। দাওয়াত দিলেন কয়েকবার, কিন্তু যাওয়া হয়নি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, তার বদলির আদেশ হয়েছে ওসমানীনগর থানায়। যেদিন যোগদান করেন ওইদিনই আমাকে ফোন করে জানান। মনে মনে ভাবলাম, তার ইচ্ছেটা অবশেষে পূরণ হলো। অবশ্য সেখানে যোগদানের পরই সধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। গত সোমবার রাতে তার সঙ্গে সেলফোনে সর্বশেষ কথা হয় আমার। একটি মামলার সত্যতা ও তদন্ত কার্যক্রম কোন্ পর্যায়ে তা জানতে চাই। তিনি জানালেন, মামলাটি এখনো তদন্তাধীন এবং শীঘ্রই এর আসল রহস্য উন্মোচন হবে। এর মধ্যেই বুধবার তিনি চিরবিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান যে মনের অধিকারী ছিলেন, তা বর্তমান যুগে খুবই কম। তার এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যু শুধু আমাকেই নয়, গোটা পুলিশ বাহিনীসহ সর্বত্র গভীর পীড়া দিয়েছে। তার চেয়েও কতো কঠিন অবস্থা হবে তার পরিবারের তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যাদের কারণে মোস্তাফিজুরের মতো উদার, দক্ষ, চৌকস ও মানবতার অধিকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু হয়, তাদের ভেতরে কি কোনো বোধগম্য হয় না? সংঘর্ষ বা জেদাজেদি বাদ দিয়ে তারা কেনো মানবতার পথে ফিরে আসে না? তাদের জন্য আর কতো কর্মকর্তাকে অকালে জীবন দিতে হবে? সাদা মনের ব্যক্তিত্ব ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন-এর কাছে তার আত্মার মাগফেরাত কামণা করি।
লেখক: সাংবাদিক। বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সংবাদ।