ঠিকানার অনুসন্ধানী রিপোর্ট : ৯ বছরে ২৭ বার গ্রেফতার

খালেদা জিয়ার প্রবাসী বিষয়ক উপদেষ্টা কে এই সর্দার?

তারেক রহমানের দুই উপদেষ্টার সাথে জেএফকে এয়ারপোর্টে জাহিদ এফ সার্দার সাদী। ছবি- এনা।
তারেক রহমানের দুই উপদেষ্টার সাথে জেএফকে এয়ারপোর্টে জাহিদ এফ সার্দার সাদী। ছবি- এনা।

নিউইয়র্ক থেকে এনা: ব্যাংকের সাথে পৃথক ২৭টি প্রতারণার মামলায় গ্রেফতারের পর দোষ স্বীকার করেছেন সর্দার। প্রতারণার এসব ঘটনা ঘটেছে ফোরিডা এবং আরিজোনায়। এই সর্দার দোষ স্বীকারের সবগুলো মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন ফোরিডার মিডল ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর এ আপিল মামলার রায়ে ৩ সদস্যের সার্কিট জজ (কারনেস, মারকাস এবং প্রিয়র) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাকে প্রতারণার জন্যে যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তা যথার্থ ছিল। পুরো নাম সর্দার জাহিদ ফারুক। আরিজোনায় ব্যাংকের সাথে প্রতারণার সময় তিনি কখনো সর্দার জাহিদ ফারুক , কখনো সর্দার ফারুক, কখনো এস ফারুক, কখনো এফ ফারুক আবার কখনো সর্দার ফারুক এবং ফারুক সর্দার নাম ধারণ করেছেন বলে কোর্টের নথিতে দেখা গেছে। এই সর্দার জাহিদ ফারুক বাস করতেন আরিজোনার ফিনিক্স সিটিতে। ফোরিডায় তার আবাস হচ্ছে ওরল্যান্ডোতে। কখনো কখনো মায়ামী এবং জ্যাকসনভিলের ঠিকানাও ব্যবহার করেছেন। মামলার নথিতে তার জন্ম তারিখও দুটি। একটি হচ্ছে ১৯৭৬ সালের ১২ মার্চ। অপরটিতে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ। মামলার নথি অনুযায়ী, প্রতারণার ঘটনায় সর্বপ্রথম তিনি গ্রেফতার হন ১৯৯৮ সালের ৪ জুন। ফোরিডার আল্টামন্টে স্প্রিং পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাকে গ্রেফতার করেছিল।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত জাহিদ এফ সর্দার সাদীর নিয়োগকৃত চিঠি। ছবি- এনা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত জাহিদ এফ সর্দার সাদীর নিয়োগকৃত চিঠি। ছবি- এনা।

এ বছরের এপ্রিল মাসেও তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার নম্বর ছিল এ০০৮৬৮২১। আমেরিকায় বাংলাদেশীদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে এবং জেল-জুলুম খাটছে। কিন্তু ৯ বছরে টানা ২৭ বার গ্রেফতারের ঘটনা অন্য কারোর প্রবাস জীবনে ঘটেছে বলে জানা যায়নি। সর্দার জাহিদ ফারুকের বিষয়টিও আলোচনায় আসেনি এক বছর আগেও। তার কাছাকাছি এবং যারা তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা তাকে ধিক্কার দিয়েছেন এমন ধাপ্পাবাজির জন্যে। কেননা, এই প্রতারক এতই সেয়ানা যে, বেশী অর্থ একত্রে কারো কাছে নেননি বা বড় অংকের চেকও ইস্যু করেননি। ঘটনাটি গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে বছর খানেক আগে জাহিদ এফ সরদার সাদী নামক এক ব্যক্তিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ”বিশেষ উপদেষ্টা ও বৈদেশিক দূত” হিসেবে নিয়োগের পর। তাকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। বিএনপির প্যাডে সেই চিঠিতে স্বাক্ষর রয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাংগঠনিক কোন কর্মকান্ডেই যাকে কখনোই দেখা যায়নি তেমন ব্যক্তি এই জাহিদ এফ সর্দার সাদী। তার চালচলনও রহস্যে ঘেরা। কখন কোথায় থাকেন কেউ বুঝতে পারেন না। দাগী আসামীদের ওয়েবসাইটে দেয়া ছবির সাথে এই সাদীর হুবহু মিল দেখে অনেকে চমকে উঠেন। ফোরিডার প্রবাসীরা বিস্ময় প্রকাশ করেন, এমন একজনকে কীভাবে এতবড় দায়িত্ব দেয়া হলো? যিনি ঘনঘন জেলে যান, তেমন ব্যক্তির প্রয়োজন কীভাবে হলো দলীয় কাজে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেও একই প্রশ্ন-কীভাবে তাকে বিশেষ উপদেষ্টা ও বৈদেশিক দূত নিয়োগ করা হলো? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঠিকানার পক্ষ থেকে জনাব সাদীর সাথে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয়। তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘আমি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশে কাজ করছি। এজন্যে হিংসায় জ্বলছেন অনেকে। যদিও আমি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কোন পদ-পদবীর লবিংয়ে নেই। সে প্রয়োজন হবে না।’ ঘন ঘন গ্রেফতার, দোষ স্বীকার এবং শাস্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি সবকিছু অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে তিনি বলেন যে, সব মানুষেরই জীবনে নানা সমস্যা ঘটে থাকে। জনাব সাদী এক পর্যায়ে উল্লেখ করেন, ‘বিশেষ প্রয়োজনেই আমাকে হয়তো গ্রেফতার/মামলার মুখোমুখী হতে হয়েছে।’ কী সে বিশেষ প্রয়োজন তা অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি, শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘আমার কী পরিচয় সেটি জানলে অনেকে ৫০০ মাইল দূর দিয়ে হাঁটবে।’ বরিশালের সন্তান এবং বাংলাদেশের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে অবসরগ্রহণকারী আমলা সর্দার আজহার আলীর পুত্র সর্দার ফারুক যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করেন ১৯৯৮ সালে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় বাংলাদেশে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এদিকে, সপ্তাহ দেড়েক আগেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের উর্দ্ধতন এক কর্মকর্তার সাথে এই সাদী সাক্ষাত করেছেন। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের সময় বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকের ব্যাপারে কথা বলেছেন ঐ কর্মকর্তার সাথে-ঠিকানাকে এ তথ্য জানান সাদী নিজেই। ঐ বৈঠকে বিএনপি নেতা শরাফত হোসেন বাবুও ছিলেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কেউ যুক্তরাষ্ট্রে এলে এই সাদীর সাথেই চলাফেরা করতে দেখা যায় অনেক সময়। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির মাঠ পর্যায়ের লোকজনও অনুধাবনে সক্ষম হচ্ছেন না-আসলে ঘটছে কি? আর কেইবা এই সর্দার? তাকে যে উপদেষ্টা এবং বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেই চিঠিটিও তিনি ঠিকানাসহ অন্যান্য মিডিয়ায় সরবরাহ করেন। এই দাগী আসামীকে কেন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিতে চরম ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের বক্তব্য বেগম খালেদা জিয়ার প্রবাস বিষয়ক দূত এবং উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়ার মত কী যোগ্য আর কোন লোক ছিলো না? জাহিদ এফ সাদীকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সংখ্যাটি বর্তমানে বাজারে রয়েছে।