আজও তারা ক্রীতদাস!

আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলুপ্তি দিবস

Tea Garden Labourসুরমা টাইমস ডেস্কঃ দাসপ্রথা অনেক আগে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও দেশের চা বাগানগুলোতে আজও রয়ে গেছে এর রেশ। মধ্যযুগের এই বর্বর ও অমানবিক প্রথার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো বাগানের চা শ্রমিকরা। আজও তারা যেন ক্রীতদাস! শ্রমের ন্যায্য হিস্যা তারা পায় না। ইচ্ছা করলেও অন্যত্র গিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই তাদের। চা বাগানের শ্রমিক লাইনের মধ্যেই বংশ পরম্পরা তাদের জীবন কেটে যায়। চা বাগানেই তাদের জন্ম, মৃত্যুও সেখানে।
নিয়ম অনুযায়ী চা গাছ ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না। ঠিক তেমনই যেন শ্রমিকদের জীবন। সীমাবদ্ধ এক জীবন। বাগানে যে লেবার লাইন (শ্রমিক কলোনি) আছে এর ২২২ বর্গফুটের একটি ছোট্ট ঘরে তাদের জীবন বন্দি। এক ফোঁটা পানির জন্য তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যে দেশে নাশতা খেতে ৬০-৭০ টাকা খরচ হয় সে দেশে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি মাত্র ৫৫ টাকা। ২০১১ সালের আগে এই মজুরি ছিল ৪৮ টাকা। সপ্তাহে রেশনের মাধ্যমে তিন কেজি চাল ও আটা দেওয়া হয়।
তেলিয়াপাড়া বাগানের চা শ্রমিক সুষমা কৈরী এ বিষয়ে বলেন, ‘বাগান মালিক এমনভাবে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেন, যার ফলে আমাদের পেটে সব সময় খিদা থাকে। পরদিন কাজ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।’
কমলাগঞ্জের ৯১ বছর বয়সী শ্রমিক মঙ্গল ঘাটোয়াল চা শ্রমিকদের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের কথা জানান। এ দেশের চা বাগানে যেসব শ্রমিক কাজ করে, তাদের পূর্বপুরুষদের বেশির ভাগকেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ধরে আনা হয়। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ মালিকরা সিলেটের মালিনীছড়ায় সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করার পর থেকেই শ্রমিকদের ক্রীতদাস হিসেবে আনা হয়। সেই প্রচলন এখনো বজায় রয়েছে। এর মধ্যে ১৯২১ সালের দিকে শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে দেশে চলে যেতে চাইলে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ পুলিশ। এতে বেশ কিছু শ্রমিক মারা যায়।
বিভিন্ন বাগানে গিয়ে দেখা যায়, সকালে এক মগ লবণ চায়ের সঙ্গে দু’মুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যায় শ্রমিকরা। চা উৎপাদন করলেও দুধ-চিনি দিয়ে সেই চা খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের। সারা দিন দাঁড়িয়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম করে তাঁদের দিন কাটে। ২৩ কেজি পাতা তুললেই কেবল দিনের কাজ পূর্ণ হয়। এর হেরফের হলেই হাজিরা কাটা যায়।
শ্রমিকরা শুধু চা তোলার কাজই করে না, তাদের বাগানের গাছ ছাঁটার কাজও করতে হয়। প্রতিদিন অন্তত ২৫০টি গাছ ছাঁটতে হয়। এক একর জমিতে কিটনাশক ছিটালে এক রোজের হাজিরা খাতায় ওঠে। দুপুরে খাওয়ার মেন্যুতে থাকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি। কারো কারো ভাগে জোটে মুড়ি আর চানাচুর। চা শ্রমিক নেত্রী রাধামনি মুণ্ডা বলেন, এখন একজন রিকশাচালক যেখানে দিনে ৬০০-৭০০ টাকা রোজগার করে, সেখানে চা শ্রমিকদের প্রতিদিনের হাজিরা দেওয়া হয় তিন ক্যাটাগরিতে মাত্র ৬৬, ৬৭ ও ৬৮ টাকা।
শ্রমিকদের মুখে ঠিকমতো আহার না জুটলেও প্রতিটি চা বাগানের অলিগলিতে রয়েছে মদের ভাটিখানা। এটা ব্রিটিশ প্রশাসন কৌশল ছিল। অর্পণ গোয়ালা জানান, চা বাগানে সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে টাকা আয় হয় তার বেশির ভাগই মদপানের পেছনে ব্যয় হয়।
মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক কামিনী গোয়ালা জানান, বাগানে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। প্রায়ই পাতা ছিঁড়তে গিয়ে হাত-পা ফুলে যায়, রক্তাক্ত হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও সাপ-বিছার কামড় খেয়ে কাজ করতে হয়। সন্তানের শিক্ষা মেলে না, চিকিৎসা মেলে না। বংশ পরম্পরায় শত শত বছর বাস করেও বাড়ির জমি নিজের হয় না। শুধু চা শ্রমিক হলেই সে ঘরে বাস করার অধিকার মেলে।
একাধিক চা শ্রমিক জানান, দেশে সর্বমোট ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাগান বন্ধ আছে। লক্ষাধিক চা শ্রমিকের পাশাপাশি অন্যান্য শ্রমিক রয়েছে সাত লাখের মতো। স্বীকৃত পেশা হিসেবে এখন বিশ্বের কোথাও দাসবৃত্তির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু জোরপূর্বক শ্রম, আটকে রেখে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজে বাধ্য করা, শিশুদের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা এবং মানবপাচারের মতো কর্মকাণ্ড ব্যাপকহারে চলছে। জাতিসংঘের ভাষায় যেগুলোকে ‘আধুনিক দাসত্ব’ বলা হয়। পিছিয়ে পড়া জনবহুল দেশগুলোতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রবণতা বেশি হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার করা শিশুদের একটি বড় অংশের গন্তব্য উন্নত বিশ্ব। সেখানে শিশুদের সস্তা শ্রম ও যৌনকাজে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলুপ্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনটি পালনে বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি কোনো কর্মসূচির কথা জানা যায়নি। –