‘আমাকে নিয়ে যাও, ও আমাকে মেরে ফেলবে’

full_697244912_1415978942সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বুধবার রাত ১১টা। প্রকৌশলী বাবা নুরুল ইসলামের মোবাইলে ফোন দেয় একমাত্র মেয়ে মেহজাবিন। বাবা-মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘ ৩২ মিনিট কথা হয়। এ সময় মেহজাবিন বাবাকে বলেন, বাবা আমি আর এ বাসায় থাকতে পারছি না। আমাকে নিয়ে যাও। যেকোনো সময় হুমায়ুন সুলতান (স্বামী) আমাকে মেরে ফেলবে।
দীর্ঘ ফোনালাপে মেয়ে বাবাকে আরো বলেন, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে আর পড়াশুনা করতে দিতে চাচ্ছে না। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে দেয়নি। জানুয়ারির ১ তারিখে এফসিপিএস পরীক্ষাও দিতে দেবে না।
মেয়ের এসব কথা শুনে বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, দু-একদিনের মধ্যে আমি ঢাকায় এসে তোর শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে যাবো। তুই কষ্ট করে এফসিপিএস পরীক্ষাটা শেষ কর। মেয়েকে বুঝিয়ে ফোনালাপ শেষ করেন বাবা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, কনা সম্প্রতি হলি ফ্যামিলি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে (বিএসএমএমইউ) এফসিপিএস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন।
খান টিপু সুলতান বলেন, তাঁর বড় ছেলে হুমায়ুন সুলতানের স্ত্রী কনা গতকাল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। দুপুর দেড়টার দিকে কনাকে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডিএমপির ধানমণ্ডি বিভাগের এসি রেজাউল করিম বলেন, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে কনা আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে তাঁর শ্বশুরপক্ষ। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, গত বুধবার টেলিফোন কল নিয়ে বিরোধের জের ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। বিষয়টি হাতাহাতি পর্যায়ে গড়ায়। এরপর গতকাল সকালে তাঁরা দুজনে বাসা থেকে বের হয়ে দুজনের কাজে চলে যান। দুপুর দেড়টার দিকে কনা বাসায় ফিরে গৃহপরিচারিকাকে বলেন, তাঁর কাজ আছে। কেউ যেন তাঁকে ‘বিরক্ত’ না করে। এই বলে তিনি বেডরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে দুপুরে খাবারের জন্য ডাকাডাকি করা হয় তাঁকে। সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে পরিবারের লোকজন ভেতরে ঢুকে বাথরুমে গ্রিলের জানালার সঙ্গে ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় তাঁকে দেখতে পায়। দ্রুত তাঁকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
কনার মামা শহীদুর রহমান হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, কনার বাবা যশোরের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম পিডাব্লিউডির অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, মা এক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর ভাগ্নিকে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন শহীদুর রহমান।
হাসপাতালে কনার সহপাঠী ডালিয়া নওশীন সাংবাদিকদের জানান, কনার পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন তাঁরা। তা ছাড়া আত্মহত্যা বলা হলেও গলায় ওড়নার ছাপ গভীর নয়।
টিপু সুলতানের পরিবার এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা দাবি করলেও কনার বাবা নুরুল ইসলাম পুলিশকে বলেছেন, মেয়ের মৃত্যুতে তাঁর সন্দেহ আছে। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, দুই বছর আগে পারিবারিক আয়োজনে টিপু সুলতানের বড় ছেলে হুমায়ুন সুলতানের সঙ্গে কনার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তাঁদের জানানো হয়েছিল যে হুমায়ুন ব্যারিস্টার, কিন্তু পরে তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁদের জামাতা ব্যারিস্টার নন। তিনি বলেন, এরপরও সবই মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু মেয়েটাকে মেরে ফেলল। এই বলেই কেঁদে ফেলেন নুরুল ইসলাম।
সন্ধ্যায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে কনার লাশ ধানমণ্ডি থানায় নেয় পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতেই কনার লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করবে, এরপর ময়নাতদন্ত নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে আদালতে কনার পরিবার প্রতিকার চাইতে পারবে।
এদিকে, টিপু সুলতানের ছেলে হুমায়ুন সুলতান স্ত্রী হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। মামলার পরপরই তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় বলে জানান থানার ওসি আবু বকর।
এর আগে থানায় হুমায়ুনের সঙ্গে পুলিশের কর্মকর্তাদের সখ্য দেখে নুরুল ইসলাম অভিযোগ করেছিলেন, প্রভাব খাটিয়ে এই ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
মামলা হওয়ার আগে রাতে ধানমণ্ডি থানায় গিয়ে দেখা যায়, ওসির কক্ষে হুমায়ুনের সঙ্গে তার বন্ধু পরিচয় দিয়ে রয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এএসপি রিয়াজুল ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে এএসপি রিয়াজ বলেন, আমার বন্ধু হুমায়ূন। তার জন্য থানায় এসেছি। কাউকে প্রভাবিত করছি না।