জামায়াত-শিবিরের থার্ড ফোর্স মাঠে : হুল ফুটাচ্ছে ‘ফুলকুঁড়ি’

fulkuriনুরুল হক শিপুঃ জামায়াত ইসলামী, ছাত্রশিবির কিংবা একই ঘরনার কোন সংগঠনের প্রায় সব নেতাকর্মীরাই পরিচিত মুখ। একেকজন নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা। হরতালে সহিংসতা ঘটলেই তাই ঘুরে ফিরে একই বলয়ের নেতাকর্মীদের মুখোমুখি হতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ বাহিনীর। এ অবস্থায় জামায়াত-শিবিরের জন্য ত্রাতা হয়ে এসেছে একটি সংগঠন। উঠতি বয়সী তরুণ-নির্ভর এ দলটি হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের শিশু সংগঠন ‘ফুলকুঁড়ি আসর।’ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে জামায়াত-শিবিরের যথক তখন হরতাল পরিস্থিতি ও সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে এমনই তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে। সারা দেশে এ চিত্রের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল সিলেটে। গত বৃহস্পতিবার জামায়াতের হরতাল চলাকালে দেখা গেছে থার্ড ফোর্স হিসেবে ফুলকুঁড়ির সদস্যরা হরতালে পিকেটিং করছে। শিশুকিশোর সংগঠনের আবরনে যেন হুল ফুটাচ্ছে তারা।
ঘটনাস্থল সিলেট শহরতলীর বলাউড়া। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করার জন্য একদল শিশুকিশোর রাস্তায় অবস্থান করছিল। আরেকদল ছিল তেমুখী এলাকায়। এ দুটো দলের হরতালের পিকেটিং চলছিল অনেকটা ছেলেখেলার মতো করে। সড়কের এক পাশে কাভার্ড ভ্যান ফেলে রেখে অ্যাম্বুলেন্স আটকানো, রাস্তায় টায়ার ফেলে আগুন কিংবা রাস্তার পাশে পল্লি বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে রাখা। এ কাজে নিয়োজিত কিশোরদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে ফুলকুঁড়ি আসরকে কাজে লাগানোর বিষয়টি।
ফুলকুঁড়ি সংগঠনের সাথে যারা জড়িত তারাই এক সময় যোগদেন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরে। বর্তমানে সংগঠনটি শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করছে হরতালের পিকেটিং এ। ওই সকল শিশু-কিশোররাই সিলেটে হরতালে পিকেটিং থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বর্তমানে কাজ করছে। এমন তথ্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ নিজামীর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে ৭২ ঘন্টা হরতালের ডাক দেয় জামায়াত-শিবির। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত প্রথম দফার এ হরতাল পালন করছে তারা। দ্বিতীয় দফায় আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আরো ৪৮ ঘন্টার কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটির হাইকমান্ড। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার হরতাল চলাকালে সিলেট নগরীতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজপথে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা অবস্থান নিতে না পারলেও পিকেটিং করতে দেখা গেছে ‘ফুলকুঁড়ি’ আসরের শিশু কিশোরদের। ওই দিন শিশু-কিশোররা পিকেটিং করেন, শহরতলীর বলাউরায়, টুকেরবাজার ও মিরাবাজার এলাকায়।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর ঘাসিটুলা ও কলাপাড়ার ডহর এলাকায় ফুলকুঁড়ির একটি উপ-কমিটি রয়েছে। ওই কমিটি ওই এলাকার স্থানীয় কয়েকটি স্কুলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মাঝে শিশুতোষ বই বিলি করে। পরে ওই শিশুদের হাতে তুলে দেয় মওদুদী লিখা বিভিন্ন ধরণের জিহাদি বই। সম্প্রতি ওই এলাকার একটি স্কুলের শিক্ষকরা কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ তেকে এরকম বই উদ্ধার করে ছাত্রদেরকে সর্তকও করেছেন বলে স্থানীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র মতে, ফুলকুঁড়ির সার্বিক কর্যিক্রম নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্র শিবির। দীর্ঘ দিন থেকে সিলেটে ফুলকুঁড়ির কার্যক্রমের অনুসন্ধান চালাচ্ছে ওই গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থার উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ফুলকুঁড়ি সম্পূর্ণই ছাত্র শিবিরের একটি সংগঠন। সিলেটে চলছে তাদের কার্যক্রম। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে শিশু কিশোরদের তাদের সংগঠনের সদস্য করে। তারা শিশুদের দিয়ে হরতালে পিকেটিংও করায়। বিভিন্ন কোরিয়ারের মাধ্যমে ওই সংগঠন জিহাদি বই-পত্র শিশু কিশোরদের হাতে চলে আসে। সিলেটের দরগাহ কেন্দ্রীক জামায়াত-শিবির ওই সংগঠনকে নিয়ন্ত্রন করে। তিনি বলেন, কিছু দিন আগে দরগায় শিবিরের একটি আস্তানা থেকে অনেক জিহাদি বই পত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তারা নজরদারিতে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সকল শিশু-কিশোরদের প্রথমে ইসলামী বিষয়গুলো উপস্থাপন করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা হয়। পরে তাদের মগজধুলাই করা হয়। ওরাই এক সময় শিবিরে যোগদান করে। সরকার বিরোধী আন্দোলন, হরতালে পিকেটিং, শহীদ মিনারে হামলা বিভিন্ন ধরনের নাশকতায় শিশুদের এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবারই বাচ্চাকাচ্চা রয়েছে। মানবিক একটা বিষয় রয়েছে। সেজন্য প্রশাসন ব্যবস্থায় যায়না। আর ওই সকল শিশুদেরতো ‘ব্রেন ওয়াস’ করা হয়। তবে মূল হুতাদের ব্যাপারে নজরদারি রয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, সিলেট মহানগরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার শিশু-কিশোর ফুলকুঁড়ির সদস্য। সিলেট মহানগরীতে রয়েছে তাদের ২৫ টি উপ শাখা। কোনো ওয়ার্ড বিত্তিক নয় ওই শাখা গুলো। শাখাগুলো কাজ করে এলাকা বিত্তিক। উপ শাখাগুলো প্রথমে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের সদস্য করে ফুলকুঁড়ির। আর সেজন্য প্রত্যেক শিশুকেই করতে হয় ফর্মপূরণ। ৯ বছর থেকে ১৮ বছরের শিশুদের নিয়ে কাজ করলেও সংগঠনটি ৩য় শ্রেণী থেকে ৭ শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়েই বেশি কাজ পরিচালনায় ব্যস্ত থাকে। আর উপ-শাখা ছাড়া ফুলকুঁড়ির সিলেট মহানগরের পরিচালানা কমিটি হলো ৩৩ সদস্যের। এছাড়া রয়েছে তাদের উপদেষ্টা কমিটিও।
ফুলকুঁড়িতে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কাউকে সদস্য করা হয়না বলে জানিয়েছেন মহানগরের পরিচালক আজহার। গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ফুলকুঁড়ি একটি জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন। আমরা ওই সংগঠন থেকে শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকি। এরমধ্যে ইসলামী সংগিত, কবিতা, সাহিত্য চর্চা, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিজ্ঞানমূলক ও সমাজসেবা, বিতর্ক প্রতিযোগীসহ শিশুদের প্রতিভা বিকাশে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর প্রতি বছর সিলেট থেকে বার্ষিক স্বারক বের করা হয়। তিনি বলেন, ফুলকুঁড়ি সরকার এর রেজিষ্ট্রেশনকৃত শিশু-কিশোর সংগঠন।
এক প্রশ্নের জবাবে নিজেকে একজন ছাত্র দাবি করে আজহার বলেন, তার নিজের রাজনীতি করার বয়স হয়েছে বলে মনে করছেন না তিনি। যারা ফুলকুঁড়ির সদস্য তারা শুধু ফুলকুঁড়িই করে। বিভিন্নস্থানে হরতালে ফুলকুঁড়ির সদস্যরা পিকেটিং করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা রাজনৈতিক ইস্যু। ফুলকুঁড়ি কেন পিকেটিং করবে। আর সিলেটে আমাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। একটি ছেলে যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা জামায়াতের মিছিলে যায় সেটিতো আমার পক্ষে মনিটরিং করা সম্ভব না। প্রত্যেকের এক একটি নিজস্ব মত নিজস্ব পথ থাকতে পারে। সংগঠকরাও ভিন্নমতের ভিন্ন পথের। কিন্তু আমরা যখন ফুলকুড়ি নিয়ে কাজ করি তখন ফুলকুড়ি নিয়েই চিন্তাকরি। ’
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. রহমতুল্লাহ জানান, বাংলাদেশের শিশু আইন খুব সুন্দর। যদি শিশুরা ফৌজদারি অপরাধ করে তাহলে শিশুরা আইনের বাইরে নয়। পিকেটিং এর নামে নাশকতা করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, শিশুদের উন্নয়নে সংগঠন কাজ করতে পারে কিন্তু কোনো ধরনের নাশকতা করলে তা মেনে নেওয়া হবে না।