মহান মে দিবস : আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপন এবং একটি প্রস্তাবনা

মো: নূরুল ইসলাম মজুমদার

মহান মে-দিবস/আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ ২০১৪ উদ্যাপন উপলক্ষে সর্বপ্রথমেই স্বরন করছি, যে সকল বীর সেনানী/শ্রমিক ভাইয়েরা দুনিয়ার শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন । তাদের এ আত্বত্যাগ বৃথা যায়নি, বৃথা যেতে পারেনা। বীরত্বগাঁথা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবদি সারা পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্বরন করে আসছে। পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে ততদিন মানুষ তাদেরকে স্বরন করে যাবে। মহান মে দিবস মানুষের অনুপ্রেরনার উৎস। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে গেছেন, কোন মহৎ কাজের অর্জন, আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা রক্ত-ঝরা ছাড়া কোন দাবী আদায় হয়নি, তাই আন্তর্জাতিকভাবে মে দিবসকে স্বরন করতে না পারলে, আমাদের দেশ, জাতি ও সমাজ পিছিয়ে পড়বে। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদের চেতনাকে জাগ্রত রাখার জন্য এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন অপরিহার্য। আমরা ৩য় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, আমরা যদি এখনই সচেতন হতে না পারি, তবে ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবে। মহান মে দিবসের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কর্মঘন্টা কমানোর জন্য, কিন্তু আমাদের দেশের সমস্যা অধিক জনসংখ্যা ও দুর্নীতি। উল্লেখিত ২টি সমস্যাকে মোকাবেলা করতে না পারলে পেশী শক্তির প্রসার ঘটবে, হানা-হানি, মারা-মারি, কাটা-কাটি, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে। তাই আমাদেরকে পরিকল্পিত উপায়ে দেশের চালিকা শক্তিকে সচল রাখতে হবে। বৈষম্য দূর করতে হলে কারিগরী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আমরা চাই একটি শোষনহ্নী সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মানুষ কর্মজীবি ও গুণী জনদেরকে সম্মান করবে, যে দেশে কর্মজীবি ও গুণীজনের সম্মান নেই, সে দেশের মানুষ উন্নতি, অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জন করতে পারে না। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, মহান মে দিবসকে যথাযথ ও মর্যাদার সাথে উদ্যাপন ও শ্রদ্ধা জানাতে না পারলে আমরা যুদ্ধাদেরকে ভুলে যাব। তাদের অবদানকে চির অম্লান করে রাখার জন্য আমরা পৃথিবীর শোষিত, বঞ্চিত, মানুষের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষণা করছি। আমরা আমাদের দেশটিকে একটি দুর্নীতিমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের এ শক্তি দান করেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ধর্মের পরেই কর্মের স্থান। কর্মই জীবন, কর্ম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সকল ধর্মের মহামানব/ মনীষীরা কর্মকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। কর্মের মধ্যেই ধর্মের সকল কর্মকান্ড জড়িয়ে আছে। সততার জন্যই শ্রম। পবিত্র ইসলাম ধর্মে শ্রমিকদের কাজকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয়া হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরী পরিশোধ কর। শ্রমের মর্যাদা, মজুরী এবং শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ করার জন্য যুগে যুগে আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। মে দিবসের পেক্ষাপট আলোচনা করতে হলে চর্তুদশ, পঞ্চদশ, অষ্টাদশ, শতাব্দীর কথা এসে যায়, এ এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে সংক্ষেপে বলব, একজন শ্রমিকের দৈনিক ৮ কর্ম ঘন্টা কাজ নির্ধারণের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্টের শিকাগো ছিল ধর্মঘটের কেন্দ্র স্থল। ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখে শিকাগোতে শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শহরে সংগঠিত শ্রমিকগণ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে কাজ বন্ধ করে সমাবেশে উপস্থিত হন। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এর আগে শ্রেণি সংহতির এত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আর দেখা যায়নি, এর ফলে আন্দোলন চূড়ান্তরূপ ধারণ করে। ১লা মে তারিখের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ৩রা মে ও ৪ঠা মে তারিখের ঘটনাগুলো যা-হে মার্কেটের ঘটনা বলে পরিচিতি লাভ করে। ৩রা মে তারিখের ম্যাক-কর্মিকরিপার কারখানার ধর্মঘটী শ্রমিকদের এক সভায় পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়, এর ফলে ৬ জন শ্রমিক নিহত হয় এবং অনেকেই আহত হয়। পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে-মার্কেট স্কোয়ারে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, সভা শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই পুলিশ বাহিনী, কি কারণে সভা স্থলে গুলি চালালো তা বোধগম্য নয়, পুঁজিবাদী স্বার্থ রক্ষার জন্য মালিক পক্ষ এবং শ্রেণী সংগ্রামের ফলে তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি, উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা নেপথ্যে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাহা বুঝা মুসকিল ছিল, কারণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জয়-পরাজয়, আধিপত্য বিস্তার এবং রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত ছিল। নিয়ন্ত্রণহীন ও বিশৃংখল অবস্থার মধ্যে সভায় একটি বোমা এসে পড়ে এবং এর আঘাতে পুলিশ বাহিনীর একজন সার্জেন্ট নিহত হন, সঙ্গে-সঙ্গেই পুলিশ বাহিনীর সাথে জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ সংঘর্ষে ৭ জন পুলিশ ও ৪ জন শ্রমিক নিহত হন এবং অসংখ্য মানুষ আহত হন। হে মার্কেটে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ কর্তৃপক্ষ শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এবং শ্রমিক নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ অক্টোবর গ্রেফতারকৃত ও পলাতক শ্রমিক নেতাদেরকে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয়। ১০ ই নভেম্বর, মে দিবসের ৪ জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। মহান শ্রমিক নেতারা হলেন অ্যালবার্ট পারসন্স, অগাষ্টস্পাইজ, অ্যাডলফ ফিশার ও জর্জ এঙ্গেল। এত কিছুর পরও আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায়নি বরং পরবর্তী সময়ে আন্দোলন আরো সুসংগঠিত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমারা এর সুফল ভোগ করে আসছি।
মে দিবসের আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করছি। শ্রম ঘণ্টা কমানোর দাবিতে মে দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রম ঘণ্টা নির্ধারিত হয়েছিল কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি অফিস এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব্ কলকারখানার দিকে তাকালে আমার কি দেখতে পাই? বাস্তবতা হলো- আমরা মাস শেষে নির্ধারিত বেতনভাতা উত্তোলন করে থাকি অথচ ৮ ঘণ্টা কাজ করি না। আমরা কাজে ফাকি দেই। অনেকে প্রকাশ্যেই এই কাজটি করে থাকেন। বিভিন্ন ব্যানারে, বিভিন্ন অজুহাতে ৮ ঘণ্টা কাজ থেকে অনেকেই বিরত থাকেন। বিশেষকরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কিছু কিছু কার্যালয়ের কিছু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী খেয়ালখুশি মতো অফিসে আসেন এবং কাজ না করে অফিস ত্যাগ করে চলে যান এমনকি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন না। সরকারিভাবে নির্ধারিত বেতনের বাইরে যদি কোনো বকশিস পাওয়া যায়, সে কাজটি যে কোনো কৌশলেই অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। অপরদিকে জনস্বার্থের কাজগুলো খুবই ধীরগতিতে চলে বা কাজটি সম্পন্ন হয় না। ফলে সাধারণ জনগণ সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন। সরকারি কোনো কারখানা বা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হলে আমরা দেখতে পাই- শুধু লোকসান আর লোকসান। জাতীয় সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হানাহানি, মারামারি, পেশিশক্তি এবং বিভিন্ন কৌশলে অবৈধ উপার্জন হলো অনেকের মুখ্য কাজ। যাহা আমাদের জাতির জন্য দুঃখজনক। আমাদের এ অবস্থা মহান মে দিবসের চেতনা নয় বরং মে দিবসের চেতনাবিরোধী কাজ। ৮ কর্ম ঘণ্টা, জবাবদিহিতা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে আমাদের জাতি কিভাবে এগিয়ে যাবে এবং উন্নত দেশে পরিণত হবে? রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল বিষয়ে আইন রয়েছে কিন্তু অনেকাংশেই এর প্রয়োগ নেই। স্ব স্ব ক্ষেত্রে আমরা যেন সবাই স্বাধীন, জাতীয় স্বার্থে এর লাগাম টেনে ধরতেই হবে। শুধু বেতন ভাতা বাড়িয়েই এর সমাধান সম্ভব নয়। আমার প্রস্তাব হলো- সরকারকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেল গঠন করে অন্যায় এবং অপরাধের জন্য সংক্ষিপ্ত বিচার ব্যবস্থার (সামারি ট্রায়েল) মাধ্যমে শাস্তির বিধান করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা জরুরি। প্রস্তাবটি ভেবে দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মানুষের প্রথম মৌলিক অধিকার হলো খাদ্য। জনগণের খাদ্যের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খাদ্যে ভেজাল বিষয়টি যেন আমাদের সহনীয় হয়ে গেছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মধ্যে এ বিষয়ে সভা-সেমিনার হলেও এর কোনো কার্যকারিতা নেই। ভেজালের বাজারে আমরা সবাই যেন একাকার হয়ে গিয়েছি। সংক্ষেপে বলব, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় স্বতন্ত্র এবং সরকারিভাবে জেলা পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার কার্যালয় স্থাপন আবশ্যক। বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মে দিবসের প্রাক্কালে একবিংশ শতাব্দীর এ আধুনিক যুগে তথ্য প্রযুক্তি/প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া বিকল্প কিছুই ভাবা অথবা চিন্তা করা যায় না। একমাত্র তথ্য প্রযুক্তি/প্রযুক্তির মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা একটি মাইলফলক। দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে হলে স্থায়ী কাঠামো তৈরি করতে হবে। প্রথমেই তথ্য প্রযুক্তি/প্রযুক্তি শিক্ষাবোর্ড স্থাপন এবং প্রযুক্তি বিসিএস ক্যাডার চালু করা জরুরি। আমার প্রস্তাবটি যথাযথ বিবেচনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলি। এ হউক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
মোবাইল: ০১৭১৬-২৪২৮০৬