স্মৃতিচারণ, কৃতি নারী সম্মাননায় শেষ হলো সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি

Sylhet Womens Collegeসুরমা টাইমস ডেস্কঃ স্মৃতিচারণ আর ১১ জন কৃতি নারীকে সম্মাননা জানানোর মধ্যদিয়ে শেষ হলো সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব। এর মধ্যে ৫ জন পেয়েছেন মরনোত্তর সম্মাননা। সম্মাননা পাওয়া ওই কৃতি নারীরা নারী শিক্ষা ও নারীর অধিকার আদায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন। এঁদের কয়েকজন মহান ভাষা আন্দোলনেও ভূমিকা রেখে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। এই কৃতি নারীদের অবদানের কথা স্মরণ করে গতকাল রোববার শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছে তাদের প্ররিশ্রমে এগিয়ে যাওয়া সেই কলেজটি। কলেজকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করা ১১ জন নারীর মধ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ ১১ জনকেই দিয়েছে তাদের প্রাপ্ত সম্মান। কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি উৎসবে এমন আয়োজন সবাইকে করেছে মুগ্ধ। সম্মাননা পাওয়া এই নারীদের নিয়ে প্রকাশিত হয় তাদের ছবি সম্বলিত জীবনী দিয়ে ‘কৃতি নারী সম্মাননা স্মারক’।
সম্মাননা প্রাপ্ত ১১ জন নারী হলেন, প্রয়াত জোবেদা রহিম চৌধুরী, প্রয়াত বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী, অধ্যক্ষ হুসন্ আরা আহমদ, প্রয়াত রেবা রাণী সেন, জেবা রশিদ চৌধুরী, মোসাম্মত নুররওশন চৌধুরী, আবেদা চৌধুরী, প্রয়াত ফাতেমা চৌধুরী (পারু), প্রফেসার দিলারা হাফিজ, রাশেদা কে চৌধুরী। কৃতি ওই ১১ জন নারীর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের জন্য রয়েছে অনেক শ্রম আর ত্যাগ। তাদের জীবনীর কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
গতকাল দুপুরে অতিথিদের উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কৃতি নারী সম্মাননা অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন কলেজের নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় সিলেটের নারী শিক্ষা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক আলোচনা সভা। এর পর স্মৃতিচারণ করেন কলেজের নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা। তারা ফিরে যান পেছনে ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোতে।
নিচে কৃতি নারীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তোলে ধরা হলো
প্রয়াত জোবেদা রহিম চৌধুরী : প্রয়াত জোবেদা রহিম চৌধুরী গোলাপগঞ্জ উপজেলার শীলঘাট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন, সিলেটের প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের অগ্রদূত। তাঁর স্বামী অ্যাডভোকেট দেওয়ান আব্দুর রহিম চৌধুরী। ১৯২৮ সালে সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলাম ও শেওেবাংলা একে ফজলুল হক সিলেট আসেন। জোবেদা রহিম চৌধুরী এ সম্মেলন সফল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুথ্থানে এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান ছিল তাঁর। তিনি সিলেট মহিলা সংঘের সভানেত্রী, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড মহিলা শাখার নেত্রী, রেডক্রসের সেক্রেটারী, আপওয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিলেট এলে তিনি তাঁকে সিলেটের মহিলাদেও পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। আর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
প্রয়াত বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী : জন্ম মৌলভীবাজর জেলার রাজনগর থানার মনসুরনগরের দেওয়ান পরিবারে। স্বামী আব্দুর রশিদ চৌধুরী। প্রয়াত বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী ছিলেন একজন আলোকিত মহিলা। অসংখ্য বিদ্যাপিঠের সাথে তিনি ছিলেন নিভিড়ভাবে জড়িত। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সঙ্কটময় মুহুর্তে কলেজকে টিকিয়ে রাখতে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। তখনকার সময় তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের এক বছরের বেতনের টাকা প্রদান করেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তানদের মধ্যে মরহুম হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ষ্পীকার ছিলেন। তাঁর অন্য সন্তানদের মধ্যে মরহুম কাউসার রশীদ চৌধুরী কূটনীতিবিদ, ফরুক রশীদ চৌধুরী সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ষাটের দশকে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে তিনি ও তাঁর স্বামীর প্রথম স্ত্রীর পুত্র আমীনুর রশীদ চৌধুরী বিশেষ অবদান রাখেন। পরে তাঁর সূর্য্য সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রয়াত সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী : জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার আতুয়াজন পরগণার সৈয়দপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। মরমী কবি সৈয়দ আশহর আলী চৌধুরী তাঁর দাদা ছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি সিলেটের খ্যাতিমান আইনজীবি আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন সিলেটের নেত্রীস্থানীয় সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কর্মী। তিনি ১৯৪৫-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে যখন ওই কলেজটি বন্ধ হবার উপক্রম তখন তিনি কলেজের অস্থিত্ব রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কলেজের ছাত্রী সংগ্রেহে তিনি সিলেটের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ান। এসএসসি পাশ মুসলিম মেয়েদের কলেজে ভর্তি করেন। তিনি একজন রতœগর্ভা জননীও বটে। তাঁর সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাঁর এক সন্তান আবুল মাল আব্দুল মুহিত বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
অধ্যক্ষ হুসন্ আরা আহমদ : তিনি ১৯২৭ এর একজন অগ্রণী বিদুষী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাক্ষেত্রে যাঁর অবদান সুবিদিত। বিশেষত নারী শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে তাঁর ব্রত শুরু হয়েছে ১৯৫০ সালে। তাঁর নেতৃত্বে সিলেট মহিলা কলেজ সূচনাকালীন ক্ষুদ্র অবয়র থেকে ধীরে ধীরে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে তাঁর মেধা, শ্রম ও স্বপ্ন বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে তিনি পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে জীবন যাপন করছেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ হুসন্ আরা আহমদ ১৯৫০ সালে কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৯ সালে ওই কলেজেরই তিনি অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৮২ সালে কলেজ সরকারিকরণের অব্যবহিত পরেই অবসরে যান।
প্রয়াত রেবা রাণী সেন : প্রয়াত রেবা রাণী সেন মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার গয়ঘড় গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ১৯৩২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ওই কলেজেরই উপাধ্যক্ষ পদে আসীন হন। সিলেটের প্রগতিশীল শিক্ষায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
জেবা রশিদ চৌধুরী : জেবা রশীদ চৌধুরী সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৩ সালে ১৯ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুর রশিদ চৌধুরী মাতা সিরাজুন্নেছা চৌধুরী। তিনি ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে এসএসসি পাশ করেন। পরে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্যাজুয়েশন করেন। ছাত্র জীবনে তিনি নানাবিধ সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় গার্ল গাইডস্ এসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন অব গার্ল গাইডস্ এন্ড গার্ল, স্কাউটস্ অন্ডার প্রিভিলেজড চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম, বেগম রোকেয়া ওমেন এন্ড চাইল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ চা সংসদসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেন।
মোসাম্মত নুররওশন চৌধুরী : তিনি ছিলেন সিলেটের অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা াফিসার। তাঁর বাবা গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ির সম্ভ্রান্ত পরিবারের আব্দুজ জাহির চৌধুরী ও মাতা দেওয়ান হাছন রাজার ছেলে কাব্য বিশাদর দেওয়ান একলিমুর রাজার মেয়ে হেলাল জাহা চৌধুরী। তিনি সিলেট নগরীর কুয়ারপাড় সঙদাগরটুলা নিবাসী হাজিবিবি হাউজে ১৯৩৯ সালের ৪ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন।
আবেদা চৌধুরী : তিনি ১৯৭৩ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সরক্ষিত মহিলা আসনের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কানি হাটি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ১৫ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন।
প্রয়াত ফাতেমা চৌধুরী (পারু) : গোলাপগঞ্জ উপজেলার রণকেলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪৪ সালের ৪ঠা আগষ্ট তার জন্ম। তিনি মরহুম আব্দুল হামিদ (হামদু মিয়ার) প্রথম কন্যা সন্তান ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ও তাঁর পরিবারের ভূমিকা ছিল খুব বেশি। তিনি ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ সালে টানা ৩বার ংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
প্রফেসর দিলারা হাফিজ : তিনি ১৯৪৮ সালে জানুয়ারি মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রফেসর দিলারা হাফিজ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ইডেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করার পর ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও তিতুমীর কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ধামরাই কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ইডেন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার পর জাতীয় শিক্ষাবোর্ড ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ওই বোর্ডের তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা চেয়ারম্যান। সর্বশেষ তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন।
রাশেদা কে চৌধুরী : ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি অন্তবর্তীকালিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তিনি প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রনালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়, এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রনালয় এর দায়িত্ব পালন করেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি নিষ্ঠার সাথে তিনটি মন্ত্রনালয় পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিরপেক্ষভাবে সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী। ১৯৫২ সালে সিলেটে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা মরহুম অধ্যাপক গোলাম এহিয়া চৌধুরী ছিলেন এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। মা মরহুম ডা: শারিকুন্নেসা চৌধুরী ছিলেন একজন মহীয়সী নারী।